দিনাজপুরে দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানি অনুষ্ঠানে মিলনায়তনভর্তি মানুষ। সোমবার সকালে দিনাজপুর শিশু একাডেমি মিলনায়তনে
দিনাজপুরে দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানি অনুষ্ঠানে মিলনায়তনভর্তি মানুষ। সোমবার সকালে দিনাজপুর শিশু একাডেমি মিলনায়তনে

দিনাজপুরে দুদকের গণশুনানি

‘এত দিন আমারে ঘুরাইলো, আর আজকে ঠ্যালায় পড়ে স্বীকার করতেছে’

দিনাজপুরে বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানিতে (নেসকো) মিটার নিতে এক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে জামানত হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। গত বছর জুনে ত্রুটির কারণে নেসকো কর্তৃপক্ষ মিটারটি খুলে নিয়ে যায়। সে সময় মিটারে জমা ছিল সাত হাজার টাকা। বর্তমানে সেই মিটার চালু করতে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে আরও ২৮ হাজার টাকা দাবি করেছে। বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য দীর্ঘ সময় নেসকোর অফিসে ঘুরেছেন ওই ব্যক্তি।

সমাধান না পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত গণশুনানিতে অভিযোগ করেন দিনাজপুর সদর উপজেলার নয়নপুরের বাসিন্দা ওয়া‌লিউল ইসলাম। গণশুনানিতে অভিযোগটি উত্থাপন করা হলে নেসকো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্বীকার করেন। তিন কর্মদিবসের মধ্যে সমাধানেরও আশ্বাস দেন। এ সময় অভিযোগকারীর চেয়ারে বসে গণশুনানি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দুদক কমিশনারকে ওয়ালিউল ইসলাম বলেন, ‘স্যার এত দিন আমারে ঘুরাইলো, আর আজকে ঠ্যালায় পড়ে স্বীকার করতেছে।’

আজ সোমবার দিনব্যাপী জেলা শিশু একাডেমি মিলনায়তনে এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুধু নেসকো অফিস নয়, দিনাজপুরের বিভিন্ন সরকারি অফিসে সেবা নিতে যাওয়া সেবাপ্রত্যাশীরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠানে।

দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠানের মঞ্চে অতিথিরা। সোমবার সকালে দিনাজপুর শিশু একাডেমি মিলনায়তনে

সকাল ১০টায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলী আকবর আজিজী। পরে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং অভিযোগকারী উভয়ের কথা শোনেন এবং কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তিও করেন তিনি। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম, দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নুরুল হুদা, জেলা পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন, জেলা দুদকের উপপরিচালক আতাউর রহমান।

গণশুনানি অনুষ্ঠানে পুরো মিলনায়তনভর্তি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য বিভাগ থেকে চিকিৎসা বিভাগ, সমাজসেবা অফিস থেকে প্রকৌশলীর দপ্তর, পাসপোর্ট অফিস থেকে বিআরটিএ অফিস—প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বিআরটিএতে গাড়ি নিবন্ধনের জন্য টাকা দিয়ে নিবন্ধন পাননি, ছয় মাস ঘুরে পাসপোর্ট হাতে পাননি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না, চাকরিতে নিয়োগ পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে, কারাবন্দীকে খাবার দিতে গেলে টাকা খরচ করতে হয়, রাস্তার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, জাল সনদে নিয়োগ পেয়ে চাকরি করছেন—এমন নানা অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছেন অভিযোগকারীরা। সব শুনে কিছু বিষয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চেই সুরাহা দিয়েছেন দুদক কমিশনার, কিছু বিষয়ে সময় বেঁধে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তাকে, আবার কিছু অভিযোগ আমলে নিয়ে উল্টো অভিযোগকারীকেই দোষারোপ করা হয়েছে।

জেলা দুদক অফিস সূত্র জানায়, গণশুনানির বিষয়ে কয়েক দিন ধরে জেলায় বুথ বসিয়ে, ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে এবং মাইকে প্রচারণা চালানো হয়েছে। গণশুনানিতে মোট ১৬৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে শুধু দুদকের তফসিলভুক্ত ১২৮টি অভিযোগের শুনানি হয়েছে। অভিযোগের বিষয়গুলো সমাধান বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা সেবাপ্রত্যাশীদের আশ্বাস দিয়েছেন। দুদক প্রতিটি অভিযোগের বিষয়ে ফলোআপ গ্রহণ করবে।

বিভিন্ন অভিযোগ শুনানিকালে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দুদক কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলী আকবর আজিজী বলেন, হাওয়ার ওপরে ভরসা করে কেউ অভিযোগ করে না। মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়েই অভিযোগ করেন। অনেক কর্মকর্তাই আছেন, যাঁরা ছোট একটি কাজের জন্য সেবাপ্রত্যাশীকে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করান। যেকোনো বিষয় মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমে মানুষটার ভয়টা কাটিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় সে দালালের শরণাপন্ন হবে, যারা অফিসগুলোর বাইরে শকুনের মতো উন্মুখ হয়ে আছে খদ্দের ধরার জন্য।