
মাদারীপুরে শিরক আখ্যা দিয়ে শতবর্ষী একটি বটগাছ কাটা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের আলমমীরের কান্দি এলাকায় কুমার নদের পাড়ে থাকা গাছটির ডালপালাসহ বেশির ভাগ অংশ কাটা হয়।
আজ মঙ্গলবার সকালে প্রশাসনের লোকজন গিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করেন। গাছটির কাণ্ড, ডালপালা ও কয়েকটি শিকড় কাটা হলেও এখনো মূল শিকড় ও গোড়া কাটা বাকি।
গতকাল সকালে কয়েকজন ব্যক্তি গাছটি কাটা শুরু করেন। তাঁদের ভাষ্য, বটগাছের গোড়ায় নারীরা শিরনি ও মিষ্টি দেয়, কেউ কেউ লাল কাপড় বাঁধে। গাছটিকে দেবতা মনে করে পূজা করেন। এটা শিরক, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই তাঁরা গাছটি কাটার উদ্যোগ নেন।
প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলমমীরের কান্দি এলাকার কুমার নদের পাড়ে সত্তার হাওলাদারের মালিকানাধীন জমিতে প্রাকৃতিকভাবে শতবর্ষী বটগাছটি বেড়ে ওঠে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে গাছটি ঘিরে এলাকাবাসীসহ আশপাশের লোকজনের মধ্যে নানা বিশ্বাস ও কৌতূহল তৈরি হয়। রোগবালাই থেকে আরোগ্য কামনা করে কেউ কেউ গাছটির নিচে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালান। কেউ কেউ বিপদ থেকে বাঁচতে মানত করেন। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে বটগাছের নিচে ফুল দিয়ে পূজা করেন। তাঁদের বিশ্বাস, গাছটির ভেতরে বড় একটি সাপ থাকে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার রাতে বের হয়। ভোর হওয়ার আগে আবার গাছের ভেতরে ফিরে যায়।
আলমমীরের কান্দি এলাকার বাসিন্দা সোহেল শিকদার বলেন, স্থানীয় কয়েকজন একজোট হয়ে বটগাছটি কেটেছেন। তাঁরাই ফেসবুকে দেওয়ার পর তাঁরা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধ করতে পারেননি। তাঁরা বটগাছের নিচে মেলা ও পূজার কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের মতো অনেকে সেখানে অবসর সময় কাটান। এভাবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে বটগাছ কাটায় তাঁরা ব্যথিত।
২০ বছর ধরে আলমমীরের কান্দি এলাকায় বসবাস করেন শারমীন আক্তার (৪৫)। তিনি বলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে বটগাছটির কাছে যেত। কেউ মন থেকে বটগাছের নিচে গিয়ে নিয়ত করলে ইচ্ছা পূরণ হতো। এ জন্য হুজুররা বটগাছটা কেটেছে। সোমবার সকালে শতাধিক হুজুর একসঙ্গে জড়ো হয়ে বটগাছটি কাটা শুরু করেন। এখন গাছের প্রায় সবটাই কাটা শেষ।’
গাছ কাটা ব্যক্তিদের একজন আলমমীরের কান্দি এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘বটগাছের গোড়ায় অনেকে শিরনি, মিষ্টি দেয়। লাল কাপড় বেঁধে রাখে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। এসব শিরক। এই বটগাছকে অনেকে আল্লাহ, দেবতা বা সৃষ্টিকর্তা মনে করেন। গাছের মালিকের সঙ্গে আলাপ করেছি। গাছটি যেহেতু গুনাহের কাজ করতেছে, তাই মালিকের মতামত চাইলে তিনি গাছটি কাটতে বলেন। পরে আলেম-ওলামা ও মুসল্লিরা মিলে গাছটি কাটার উদ্যোগ নিই। গাছ কাটতে চার হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গাছটির কাঠ বিক্রি করে দেড় হাজার টাকা স্থানীয় মসজিদে জমা রাখা হবে।’
আজ দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বটগাছটি ঘিরে স্থানীয় লোকজন আলাপ-আলোচনা করছেন। গাছটি কাটায় বেশির ভাগই ব্যথিত। অনেকে প্রতিবাদও করেছেন। গাছের কাণ্ড, ডালপালা ও কয়েকটি শিকড় কাটা হয়েছে। এখনো মূল শিকড় ও গোড়া কাটা বাকি। সকালে স্থানীয় প্রশাসন গিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রমিক বা গাছ কাটাপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফর ব্যাপারী বলেন, ‘বটগাছটি কাটা ঠিক হয়নি। হুজুররা একজোট হয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তাদের এই অবস্থান দেখে আমরা বিস্মিত। এর আগেও বটগাছের নিচে বৈশাখী মেলা ও বাউলগানের আয়োজন করা হয়েছিল। তখন একশ্রেণির মানুষ বাধা দিলে আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়।’
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব প্রথম আলোকে বলেন, বটগাছটি কাটার বিষয়টি জানতে পেরে জেলার বন কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ অনেকে সেখানে গিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করেছেন। গাছটির গোড়া এখনো জীবন্ত আছে। স্থানীয় লোকজন গাছটি কাটার চেষ্টা করেছেন। যাঁরা কাটার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদের ডেকে কারণ জানতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পেরে গা ঢাকা দিয়েছেন। যাঁরা এ ধরনের অন্যায় কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বটগাছ একটি সংরক্ষিত প্রজাতি। কাটার প্রশ্নই ওঠে না। এর ফল খেয়ে অনেক প্রজাতির পাখিরা বেঁচে থাকে। এলাকার শতবর্ষী বৃক্ষগুলোকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।