
যশোরে বিএনপির সমাবেশের প্রাক্কালে দলটির নেতা–কর্মীদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে দলটির ১৩৫ জন নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলাও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নেতারা।
২৭ মে বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থাকার কথা রয়েছে।
জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলছেন, সমাবেশ বানচাল করতে ও নেতা–কর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলা ও ধরপাকড় চলছে। এমনকি দেশে নেই—এমন এক নেতাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। জেলার শীর্ষ পর্যায়ের ১১ নেতাসহ ৪৭ জনকে এমন মামলায় জড়ানো হয়েছে, যেখানে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না।
১৯ মে শুক্রবার সন্ধ্যায় যশোর শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া কাঁঠালতলা এলাকায় শতদল পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সরকার উৎখাতের জন্য বোমা, লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে অবস্থানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা ও বিস্ফোরক আইনের একটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পৌরসভার সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলাম রয়েছেন। অথচ মামলায় ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, তখন তিনি ভারতের মুম্বাইয়ে যাওয়ার ফ্লাইটে ছিলেন। ওই দিন রাত থেকেই মুম্বাইয়ে আছেন মারুফুল।
গতকাল রোববার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে মারুফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৭ মে থেকে আমি যশোরে নেই; ঢাকায় ছিলাম। এরপর ১৯ মে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ভারতে আসি। এখনো মুম্বাই শহরে আছি।’
২৭ মে যশোরে বিএনপির সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে শুক্রবার সন্ধ্যায় শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শতদল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কর্মী সভা করার প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশ সেখানে কোনো কর্মী সমাবেশ করা যাবে না বলে স্থানীয় ছয়জন নেতা–কর্মীকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি ককটেল, বোমা, ইটের টুকরো ও লাঠসোঁটা উদ্ধারের দাবি করে পরের দিন পুলিশ নাশকতার অভিযোগ এনে ৪৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করে। এতে জেলা বিএনপির ১১ জন শীর্ষনেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই মামলাকে ‘গায়েবি’ হিসেবে উল্লেখ করে বিএনপি বলছে, আসামিদের অনেকেই ঘটনাস্থলেই ছিলেন না।
যশোর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মীদের মতবিনিময় সভার দায়িত্বপ্রাপ্ত নগর (শহর) বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, ওই বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত কর্মীদের মতবিনিময় সভায় জেলা বিএনপির, যুবদল ও ছাত্রদলের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। মূলত ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের নিয়ে ওই সভা করা হয়।
আসামিদের তালিকায় যে ১১ নেতার নাম আছে, তাঁরা হলেন যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন, সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক, কমিটির সদস্য ও যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান, মারুফুল ইসলাম, কাজী আজম, মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী যুবদলের জেলা কমিটির সহসভাপতি আমিনুর রহমান ও যুগ্ম সম্পাদক নাজমুল হোসেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জেলা কমিটির সভাপতি রাজিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান।
মামলার আসামি জেলা বিএনপির সদস্য মিজানুর রহমান খান বলেন, জেলা বিএনপির কোনো নেতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি জেলা ছাত্রদল ও যুবদলেরও কেউ ছিলেন না। অথচ সবার নামে ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে পুলিশ আবারও নাটক সাজিয়েছে।
শুক্রবারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে তিনজনকে সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। দুজনের একজন শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া বউবাজার এলাকার মুদিদোকানদার ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলের মাঠে প্রোগ্রাম করার জন্য বিএনপির নেতা–কর্মীরা আসেন। পুলিশ গিয়ে রেড (তল্লাশি) দেয়। অনেক ভিড়ভাট্টা দেখলাম। পুলিশ একটা কাগজে সই করে দিতে বলল, দিলাম।’
অপর সাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা নির্মাণশ্রমিক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মাঠে স্থানীয় বিএনপির নেতারা ছিলেন। পুলিশ এসে কয়েকজনকে ধরে। পুলিশের কথামতো সাক্ষীর কাগজে সই করে দিয়েছি।’
যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, গায়েবি মামলা বলে কিছু জানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতেই বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক উপাদানাবলি আইনে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকেই কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তো নিষিদ্ধ না। দলের মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর যশোরের সমাবেশে বক্তৃতা করতে আসবেন। সেই কর্মসূচি সফল করার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মী সভা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বিদ্যালয়ের মাঠে শান্তিপূর্ণ সেই কর্মী সভা চলাকালে পুলিশ গিয়ে কর্মী সভা করা যাবে না বলে কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করে। সেখানে বোমা-ককটেল বা লাঠসোঁটা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ পুলিশ বোমা–ককটেল উদ্ধার দেখিয়ে নাশকতার মামলা দিয়ে জেলা ও স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ঘটনার আগে থেকেই জেলা কমিটির সদস্য মারুফুল ইসলাম ভারতে অবস্থান করছেন। অথচ তাঁকেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এদিকে রোববার যশোর আদালতের হাজতখানায় আটক দলীয় নেতা–কর্মীদের খাবার দিতে গেলে অভয়নগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফারাজী মতিয়ার রহমান ও যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম হায়দারকে আটক করে পুলিশ। এ ছাড়া মনিরামপুর থেকে ১১ ও চৌগাছা উপজেলা থেকে ২ জনকে আটক করা হয়েছে। এ নিয়ে গত পাঁচ দিনে যশোর জেলার আট উপজেলা থেকে বিএনপির ১৩৫ নেতা–কর্মীকে আটক করে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।