
জোড়া কবুতর হাতে শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেবাশীষ দাশ (৫৬)। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে এসেছেন তিনি। বললেন,‘আমার ছেলে শুভ দাশ খুব অসুস্থ ছিল অনেক দিন। কিছুতেই রোগ সারছিল না। ছেলের আরোগ্যলাভের জন্য কবুতর মানত করেছিলেন তার মা। ছেলে এখন সুস্থ। তাই সপরিবার মানত পূরণ করতে এসেছি।’
চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরমা বাইনজুরীতে অবস্থিত শুক্লাম্বর দিঘি। প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তিতে দিঘির পাড় ঘিরে মেলা বসে। লোকমুখে মেলাটির নাম ‘বিশ্বাসের মেলা’। মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি পাশের দেশ ভারত, নেপাল থেকেও জড়ো হন বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। এখানে যাঁরা আসেন, তাদের ভাষ্যমতে, বিশ্বাস করে দিঘির কাছে কিছু চাইলে তা পাওয়া যায়। মানত পূরণ করতে সংক্রান্তির শুভদিনে বিশ্বাসীদের সমাগম ঘটে দিঘির পাড়ে। সেই থেকেই মেলার নাম বিশ্বাসের মেলা।
আজ মঙ্গলবার সকালে শুক্লাম্বর দিঘির পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, পুণ্যার্থীরা কেউ দিঘিতে স্নান করছেন। কেউ দুধ ঢালছেন দিঘিতে। কেউ কবুতর ও ছাগল গোসল করিয়ে পাশের লালসালু বাঁধা অশ্বত্থগাছের সামনে ছেড়ে দিচ্ছেন। গাছের সামনে বসে প্রার্থনাও করতে দেখা যায় অনেককে। দিঘির পাড়েই রয়েছে একটি মন্দির। মন্দির কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য অমর কান্তি ভট্টাচার্য (৬০) জানান শুক্লাম্বর দিঘির গল্প।
অমর কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য নামের এক সাধকের নামে এ দিঘির নাম। কথিত আছে, প্রায় ৭০০ বছর আগে ভারতের নবদ্বীপ বা নদীয়া থেকে এসে শঙ্খ নদের পাড়ে সাধনায় বসেন শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য। সাধনার জন্য তিনি সেখানে একটি দিঘি খনন ও দিঘির পাড়ে একটি অশ্বত্থগাছ রোপণ করেন। পরে শঙ্খ নদ একসময় পাড় ভাঙতে ভাঙতে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চলে যায়। নদী দিয়ে একটি মরা গরু ভেসে এলে সাধকের অলৌকিক শক্তিতে গরুটি জীবিত হয়ে যায়। প্রায় ৫০ বছর সাধনাজীবন শেষে তিনি দিঘির পাড় থেকে অলৌকিকভাবে লুপ্ত হয়ে যান। সাধনাকালে এই অঞ্চলের অনেকেই বিভিন্ন আধ্যাত্মিক শক্তি দেখে তাঁর ভক্ত হন।
ভক্তদের মাধ্যমেই দিঘিটি নিয়ে অলৌকিক ধারণা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সেই সময় থেকেই সংক্রান্তির দিন দিঘির পাড়ে মানুষ জড়ো হতে থাকেন মনোবাসনা পূরণের জন্য। দিঘির ঘাটে দেখা মেলে নেপালী ধর (৬০) ও প্রিয়াঙ্কা ধরের সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন একটি ছাগল নিয়ে মানত পূরণ করতে।
দিঘিটিকে ঘিরে এমনও বিশ্বাস আছে, মানত করে গাভির দুধ দিঘিতে ঢাললে সেই গাভি দুধ বেশি দেয়। এ কারণে সংক্রান্তির দিন খামারি ও গোয়ালাদের ভালো সমাগম দেখা যায় দিঘির পাড়ে। তবে দুধ নাকি দিঘির পানিতে মেশে না। নিচের দিকে চলে যায়। এ কথা জানান দিঘি উন্নয়ন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চৌধুরী।
দিঘির পশ্চিম পাড়ে বিশাল জমিতে মেলার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সেখানে গিয়ে কথা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার টইটং এলাকার ফজল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে মেলায় দোকান দেন তিনি। জবধানের খই, গইশ্যার তিল, ছোলা, নাড়ুসহ আরও অনেক খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসেন। এখানে ভালো পরিবেশে বেচাবিক্রি হয়।
পশ্চিম পটিয়ার কাশিয়াই গ্রামের দেবু বর্ধন (৪৭) নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এ মেলা তাঁদের জন্য একটি ঐতিহ্য। তাঁর বাবা গণেশ বর্ধনের সঙ্গে ৩২ বছর ধরে মেলায় বেচাবিক্রির জন্য আসছেন তিনি। এর আগে তাঁর দাদা আসতেন। বেচাবিক্রি খুব ভালো হয়। পরিবেশও ভালো। তবে মেলার দিন রাত ৯টার পর চলে যেতে হয়। তাই মেলাটি দুই দিন হলে ভালো হতো।
তবে শুধু বিশ্বাস কিংবা সংক্রান্তির উৎসব নয়; শুক্লাম্বর দিঘির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও। স্থানীয় লোকজন জানান, ১৯৭১ সালে বাইনজুরী গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঘরহারা অনেক মানুষ তখন আশ্রয় নেন দিঘির পাড়ে এবং অশ্বত্থের তলায়।