
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁরা সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করছেন। অনেকে ধারদেনা করে ওষুধ কিনছেন।
রোগীরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরই তাঁরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেও তাঁদের ভর্তি নেওয়া হয়নি। দূর থেকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো ওষুধও দেওয়া হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে তাঁরা ওষুধ কিনে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
গত ২৭ আগস্ট সুন্দরগঞ্জের বেলকা ইউনিয়নের কিশামত সদর গ্রামে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত একটি গরু জবাই করা হয়। গরু কাটাকাটিতে অংশ নেওয়া ১১ জনের শরীরে দুই দিন পর ফোসকা পড়ে। অ্যানথ্রাক্সের নানা উপসর্গ দেখা যায়। তাঁরা হলেন কিশামত সদর গ্রামের মোজাফফর আলী (৫০), মোজাহার আলী (৬০), শফিউল ইসলাম (৩৫), গোলজার মিয়া (২৫), খতিব মিয়া (৩৫), হাসান আলী (১৫), নুরুন্নবী মিয়া (১৬), ফরিদুল মিয়া (২০), মারুফ মিয়া (১৬), কুদ্দুস মিয়া (১৬) ও মিঠু মিয়া (১৬)। তাঁদের মধ্যে মোজাফফর আলী বাঁ চোখে ১০ দিন ধরে দেখছেন না বলে জানান।
ওই ঘটনার কয়েক দিন পর পাশের পশ্চিম বেলকা গ্রামের গৃহবধূ রোজিনা বেগম (৪৫) একটি অসুস্থ ছাগল জবাই করে মাংস কাটাকাটি করেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
তবে ওই নারী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ছিলেন না বলে দাবি করেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ ছিল। খুব খারাপ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। হৃদ্রোগ ও ফুসফুসে সমস্যাসহ অন্য জটিলতা ছিল। তাঁর রক্তচাপ কমে গিয়েছিল এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
বুধবার সকালে কিশামত সদর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মোজাফফর আলী চোখ ফোলা ও বাঁ হাতে ফোসকা নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসে আছেন। তিনি গরুর মাংস কাটাকাটিতে মূল ভূমিকায় ছিলেন। গরুর রক্তের ছিটা তাঁর চোখে পড়েছিল। আক্রান্ত অন্যদের কারও এক হাতে, কারও দুই হাতেই ফোসকা পড়েছে। অনেকে হাতে ফোসকা নিয়ে সাংসারিক কাজ করছেন।
মোজাফফর আলী প্রথম আলোকে বলেন, অসুস্থ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ভর্তি হতে চাইলে চিকিৎসক ওষুধ লিখে বিদায় করে দেন। বাড়িতে ফিরে দুই দিন ওষুধ খেলেও ফোসকা ভালো হয়নি। পরে গত শুক্রবার রংপুর থেকে গাইবান্ধায় আসা এক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। তাঁর দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছেন। ১০ দিন ধরে বাঁ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার চোখের জন্য উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সেই টাকা কোথায় পাব? এখন পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা ধার করা। চিকিৎসক দুই মাস ওষুধ খেতে বলেছেন। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। ওষুধের অনেক দাম।’
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত শফিউল ইসলাম বলেন, ‘দুই হাতের ফোসকা এখনো ভালো হয়নি। এ পর্যন্ত সাড়ে আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে চড়া সুদে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা পরিশোধ করব নাকি ওষুধ কিনব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। দেড় বিঘা জমি বর্গা চাষ করে কোনোমতে সংসার চলে। মাঝেমধ্যে অন্য জেলায় গিয়ে রিকশা চালাই। এখন অসুস্থ হয়ে সেটাও পারছি না। খুব বিপদে আছি।’
গোলজার মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। এ পর্যন্ত দেনা করে ৯ হাজার চিকিৎসার পেছনে খরচ করেছি। প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হচ্ছে। একদিকে বাজার খরচ, আরেক দিকে ওষুধ কেনা—কোনটা আগে করব চিন্তা করে পারছি না।’
গরু জবাইয়ে অংশ নেওয়া নুরুন্নবীর মা নুরনাহার বেগম (৫৬) বলেন, ‘ছেলের ডান হাতে ফোসকা পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা ভর্তি নেননি। চিকিৎসক দূরে থেকে ওষুধ লিখে দেন। পরে গাইবান্ধায় গিয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসা চলছে। ছেলে অনেকটা উপকৃত হয়েছে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক বলেন, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ছিলেন না। তাই ভর্তি রাখার প্রয়োজন হয়নি।