বরিশালে গাছে ঝুলিয়ে পথকুকুরকে হত্যার ভিডিও ভাইরাল

গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় পথকুকুরটিকে। সোমবার বিকেলে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ইউনিয়নের দুর্গাপুরে
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে একটি পথকুকুরকে গলায় রশি বেঁধে গাছের সঙ্গে  ঝুলিয়ে ও পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন স্থানীয় একদল যুবক। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে (ভাইরাল) এ নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন অনেকে। বিষয়টি নজরে আসার পর এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করেছে উপজেলা প্রশাসন। একজনকে আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে।

পশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯২০ সালের পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইন (সংশোধিত প্রাণিকল্যাণ আইন-২০১৯) অনুযায়ী, মালিকবিহীন কোনো প্রাণী হত্যা করলে ছয় মাসের জেল অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। চলাফেরার সুযোগ না দিয়ে কুকুরকে একটানা ২৪ ঘণ্টা বেঁধে বা আটকে রাখলে তা হবে নিষ্ঠুরতা। এ অপরাধের জন্য ছয় মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, খালের পাড়ের একটি কাঁচা রাস্তায় দাঁড়ানো একটি পথকুকুরের গলায় মোটা লম্বা একটি রশি লাগিয়ে পাশেই একটি রেইনট্রিগাছের মোটা ডালের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রশিটি টান দিয়ে ধরে রেখেছেন এক যুবক। পাশে অপর এক যুবক মোটা লাঠি নিয়ে ঝুলে থাকা কুকুরটির মাথায় বেধড়ক পেটাচ্ছেন এবং ‘ভিডিও কর...ভিডিও’ বলে চিৎকার করছিলেন। এসব দৃশ্য পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন চার থেকে পাঁচজন যুবক এবং তিন-চারটি শিশু। সবাই হাততালি দিচ্ছিল এবং ‘মরে নাই...মরে নাই’ বলছিল। একটানা পিটুনিতে কুকুরটির মাথা নেতিয়ে পড়লেও ওই যুবক পেটানো অব্যাহত রাখেন।

ভিডিওটি নিজের ফেসবুক আইডি থেকে শেয়ার করেন মোজাম্মেল হোসেন (মোহন) নামের এক ব্যক্তি। তিনি ‘গর্বের বাকেরগঞ্জ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। পিটিয়ে কুকুর হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে কয়েকটি পোস্টও করেন তিনি।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওর সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনাটি সোমবার বিকেলে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি জানান, কুকুরটিকে রশিতে বেঁধে ফাঁস দেন ওই গ্রামের খোকন হাওলাদার (৪২)। আর কুকুরটিকে মোটা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায় একই এলাকার কিশোর বয়সী এক ছেলে। আর ভিডিও ধারণ করে আরেক কিশোর। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দাবি, তিন-চারটি কুকুর সম্প্রতি এ এলাকায় কয়েকটি ছাগল কামড়েছে এবং লোকজনকে তাড়া করছিল। এ জন্য কুকুরটিকে মেরে ফেলেছেন তাঁরা।

তবে ভিডিওটি ছড়িয়ে দেওয়া মোজাম্মেল হোসেন মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভিডিওটি একটি মাধ্যমে পাওয়ার পর বিবেকের তাড়নায় এটা ফেসবুকে আপলোড করেছি। আমার বাড়ি পাশের গ্রামেই। আমি যত দূর জেনেছি, কুকুরটি নিরীহ, কাউকে কোনো ক্ষতি করেনি। মূলত পাশবিক আনন্দ পেতেই মজা করে একটি নিরীহ প্রাণীকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে মোজাম্মেল বলেন, ‘এ ঘটনা শুধু একটি কুকুর হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে—আমরা কীভাবে আরও অসংবেদনশীল, আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছি? যখন একটি প্রাণীও নিরাপদ নয়, তখন মানবিকতা কতখানি সুরক্ষিত, সে প্রশ্ন সবার সামনে চলে এসেছে।’

এদিকে নির্মমভাবে কুকুর হত্যার ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর বাকেরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তন্ময় হালদার মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থলে যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম সঙ্গে ছিলেন। সরেজমিন তাঁরা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করেন। জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র খোকন হাওলাদার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাঁকে তাৎক্ষণিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া অন্যরা অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার অঙ্গীকার–সংবলিত মুচলেকা নেওয়া হয়। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

তন্ময় হালদার মঙ্গলবার প্রথম আলোক বলেন, কুকুরটিকে এমন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে যে এর ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত দেখার মতো নয়। পশুর প্রতি এমন নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ অগ্রহণযোগ্য এবং তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে উপজেলা প্রশাসনকে তা তাৎক্ষণিক অবহিত করার জন্য স্থানীয় ব্যক্তিদের অনুরোধ করা হয়েছে।