হাউসবোটে আগুন

‘রাহবার’ আবারও ভাসবে টাঙ্গুয়ার হাওরের জলে

আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে হাউসবোট ‘রাহবার’
ছবি: বোটের মালিকের ফেসবুক থেকে নেওয়া

কাঠের তৈরি হাউসবোটের নাম ছিল ‘রাহবার’। একেবারে নতুন, সাজানো-গোছানো। কাঠে মাখানো রঙের গন্ধ লেগে ছিল। সামনে দোলনা, ছাদে সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন, নানা জাতের ফুলের গাছ। ফাঁকে ফাঁকে ছিল পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা। ভেতরে ঝকঝকে, তকতকে ছয়টি কক্ষ। টাঙ্গুয়ার হাওরের জলে নামে রাহবার। এই হাউসবোট ঘিরে ছিল এক তরুণের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। কিন্তু জলে নামার এক সপ্তাহ না যেতেই তরুণের সেই স্বপ্ন, আশা থমকে দাঁড়ায়। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হাউসবোটটি।

বছরের পর বছর রক্তে-ঘামে জমানো অর্থে হাউসবোটটি বানিয়েছিলেন তরুণ খায়রুল কবির (সামী)। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় তাঁর বাড়ি। সেখানে একটি পাঞ্জাবির ছোট শোরুম আছে তাঁর। খায়রুল নিজেও একজন পর্যটক। ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। একসময় নিজেই ট্যুর আয়োজন শুরু করেন। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে এসে নানা রঙের হাউসবোট দেখে বিষয়টি মনে ধরে তাঁর। নিজেও এ রকম একটা বোট বানানোর স্বপ্ন দেখেন। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে শুরু করেন হাউসবোট তৈরির কাজ। এটি বানাতে তাঁর ব্যয় হয় ২২ লাখ টাকা।

‘এবার বর্ষায় হাওরে আসার আমন্ত্রণ। আপনাদের হাউসবোট অপেক্ষায় আছে।’ ২১ মে নিজের ফেসবুক আইডিতে হাউসবোট রাহবারের চমৎকার কিছু ছবি দিয়ে এ কথা লিখে পোস্ট দেন খায়রুল কবির। এরপর দুটি প্যাকেজে দুইবার হাউসবোটটি পর্যটকদের নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়িয়েছে। তৃতীয় ট্যুর ছিল ৩০ মে। ১২ জন পর্যটককে নিয়ে হাওরে যায় বোট। সারা দিন হাওরে ঘোরেন পর্যটকেরা। সন্ধ্যায় হাউসবোট পর্যটকদের নিয়ে রওনা হয় হাওরের উত্তর পাড়ের শহীদ সিরাজ লেকের (নীলাদ্রি) উদ্দেশে। এখানেই হাউসবোটে পর্যটকেরা রাত যাপন করেন। ঘুরে বেড়ান আশপাশের নীলাদ্রি লেক, বারেক টিলা, শিমুলবাগান ও যাদুকাটা নদীর তীরে।

খায়রুল কবির জানান, বোটটি হাওরের ডাম্পের বাজারের কাছাকাছি যায় গত শুক্রবার রাত আটটার দিকে। তখন পর্যটকেরা ছিলেন বোটের ছাদে। এমন সময় পাশের আরেকটি বোট থেকে লোকজন তাঁর বোটে আগুন দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে পাশের বোটটি ছুটে এসে আগুন লাগা বোট থেকে পর্যটকদের দ্রুত সরিয়ে নেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো বোটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় রাহবার। তবে পর্যটক এবং বোটে থাকা অন্যদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

টাঙ্গুয়ার হাওরে গত শুক্রবার রাতে রাহবার নামের একটি হাউজবোট আগুনে পুড়ে যায়।

প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলেছিল, বোটে থাকা গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে খায়রুল কবিরের ভাষ্য, বোটে গ্যাসের সিলিন্ডার থাকে পেছন দিকে। আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বোটের সামনের অংশে থাকা ৪ নম্বর কক্ষ থেকে। বোটের কর্মীরা সেখানে গিয়ে ওই কক্ষটি খুলতে পারেননি। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তাঁরা নিরাপদে যেতে বাধ্য হন। এরপর সব শেষ হয়ে যায়। খায়রুল কবির বলেন, ‘গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি, এটা আমরা নিশ্চিত। ওই কক্ষে হয়তো কোনো পর্যটক ধূমপান করে অসাবধানতাবশত সেটি রেখে আসতে পারেন। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। এটিও আমাদের অনুমান।’

বোটটি যেভাবে পুড়েছে, সেটি আর সংস্কার করা সম্ভব নয়। আগুনে বোটটি পুড়ে যাওয়ার পর অনেকেই খায়রুল কবিরকে সমবেদনা জানিয়েছেন। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। নিজেও প্রথমে ভেঙে পড়েছিলেন। আস্তে আস্তে সেটি কাটছে। এখন কী করবেন জানতেই চাইলে খায়রুল কবির বলেন, ‘বছরের পর বছরের রক্ত ঘাম করা অর্থে একটি স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল, নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল। এই শেষ থেকেই আমি আবার শুরু করব। আরেকটি নতুন বোট বানাব। রাহবার নাম নিয়েই এটি টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাসবে।’

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকদের প্রিয় স্থান। টাঙ্গুয়ার হাওর এবং এর আশপাশের এলাকায় বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পর্যটক আসেন। পর্যটকেরা নৌকায় করে দিনভর হাওরে ঘুরে বেড়ান। অনেকেই হাউসবোটে রাত যাপন করেন। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ শতাধিক হাউসবোট রয়েছে পর্যটকদের জন্য।

এ প্রসঙ্গে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর এবং এর আশপাশের এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ ও নৌযানের চলাফেরায় বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে। এগুলো সবাইকে অবশ্যই মানতে হবে। হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। একই সঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।