
‘স্কুলে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের কাছে টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি। জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি কয়েকবার। ১০ বার জাতীয় টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছি; সবশেষ ২০১৭ সালে খেলেছি। কিন্তু এখন অনুশীলনের জায়গাটাই নেই। ফলে নতুন কোনো খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না।’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা নুর জামান (৩৮)। অনুশীলন ছাড়াই এবারের জাতীয় টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে খেলতে যাচ্ছেন তিনি।
গত সোমবার মুন্সিপাড়ার বাসায় বসে কথা হয় নুর জামানের সঙ্গে। বাসায় আলমিরার তাকে সাজানো ট্রফি ও সনদপত্রগুলো জানান দিচ্ছে টেবিল টেনিসের প্রতি নুর জামানের ভালোবাসার কথা।
চার ভাইয়ের মধ্যে নুর জামান দ্বিতীয়। চার ভাই টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। এর মধ্যে এক ভাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেবিল টেনিস প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এসব তথ্য জানাতে জানাতে নুর জামান বলেন, ‘স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী দেখলেই তাঁদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিই। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার পরামর্শ দিই। খেলাধুলার প্রতি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শেষমেশ খেলার সামগ্রীর একটি দোকানই দিয়েছি। এখনকার প্রজন্ম টেবিল টেনিস খেলা তো দূরের কথা, খেলাটার সঙ্গে পরিচয়ই নেই অনেকের।’
স্থানীয় কয়েকজন খেলোয়াড় জানান, দিনাজপুরের ক্রীড়াঙ্গনে টেবিল টেনিস ছিল গর্বের নাম। জেলায় দুই শতাধিক খেলোয়াড় ছিলেন, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন, পেয়েছেন সাফল্য। কিন্তু অনুশীলনের জায়গা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে টেবিল টেনিসের সাফল্যগাথা। এরই মধ্যে খেলোয়াড়দের কেউ মারা গেছেন, কেউ ব্যস্ত কর্মজীবনে। অনুশীলনের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় নতুন করে খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নুর জামান বলেন, ‘আগামী ৯ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। খেলার আমন্ত্রণও পেয়েছি। দীর্ঘ আট বছর পরে কয়েকজন খেলতে যাচ্ছি, তবে কোনো ধরনের অনুশীলন ছাড়াই।’
দিনাজপুরে টেবিল টেনিসের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ‘সচেতন সংঘ’। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হেমায়েত আলী হলকে কেন্দ্র করে আশির দশকে সংগঠনটি টেবিল টেনিসের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতন সংঘের খেলোয়াড়রা জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করেন। তবে ২০০৬ সালের পর হেমায়েত আলী হলে অনুশীলন বন্ধ হয়ে যায়।
সচেতন সংঘের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক টেবিল টেনিস খেলোয়াড় খন্দকার জাকির আলী (৪২) বলেন, সচেতন সংঘের খেলোয়াড়েরা একসময় দেশে টেবিল টেনিসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেবিল টেনিসের সাবেক কোচ ও বর্তমান আম্পায়ার হাফিজুর রহমানও তিনবার দিনাজপুরে এসেছেন, খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় সেই জেলায় টেবিল টেনিস খেলার ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেছে।
মাহবুব হোসেন নামের একজন বলেন, ‘টেবিল টেনিস ইনডোর গেম; মাঠের খেলা নয়। হেমায়েত আলী হলে অনুশীলন বন্ধ হওয়ায় টেবিল টেনিসের কার্যক্রম থমকে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অনুশীলনটা অব্যাহত রেখেছিল, তারাও ধরে রাখতে পারেনি।’
সম্প্রতি কয়েকজন খেলোয়াড় হেমায়েত আলী হলে টেবিল টেনিস অনুশীলনের অনুমতি চেয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বলেন, খুব শিগগিরই হেমায়েত আলী হল কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে টেবিল টেনিস খেলার অনুশীলনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।