
তাদের এই সাফল্য প্রমাণ করে সুযোগ আর সামান্য সহযোগিতা পেলে দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়।
বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার আশঙ্কা, পিতৃহীন সংসার, মায়ের ঘামঝরা শ্রম কিংবা দোকান সামলানোর ফাঁকে পড়াশোনা—সব প্রতিকূলতার মাঝেও তারা হার মানেনি। এবারের এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় প্রত্যন্ত এলাকার এই শিক্ষার্থীরা অর্জন করেছে জিপিএ-৫। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তাদের চোখে এখন নতুন স্বপ্ন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শারমিন, কিশোরগঞ্জের আছিয়া, ঝিনাইদহের সৌরভ আর যশোরের সাবরিনার এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে সংগ্রামের দীর্ঘ কাহিনি। একসময় যাদের পড়াশোনা থমকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, তারাই আজ সবার গর্ব। এখন তাদের একটাই স্বপ্ন—শিক্ষা শেষ করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো এবং সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করা।
বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে জিপিএ-৫
বাবা অসুস্থ। শ্রমজীবী মা কখনো গৃহকর্মী, কখনো মাটিকাটা আবার কখনো কৃষিশ্রমিকের কাজ করে সংসার চালান। অভাব-অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। এমন পরিবারে জন্ম নেওয়া শারমিন খাতুনের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে ঠিক হয়। তবে শিক্ষকের সহায়তায় সেই বিয়ে ঠেকিয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রাখে শারমিন।
কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। শারমিনদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী শ্যামপুর গ্রামে। তার বিদ্যালয়টিও উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়, নাম আলীনগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
শিক্ষকদের সহায়তায়ই এই সাফল্য বলে মনে করে শারমিন। সে প্রথম আলোকে বলে, ‘শিক্ষকের সহায়তা না পেলে বাল্যবিবাহতেই থমকে যেত জীবন। আমার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে, একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা। মা-বাবার মুখে হাসি ফোটানো।’
মাধ্যমিকে বিনা পয়সায় রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা পড়ানো শিক্ষক মো. আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ি থেকে বিদ্যালয় থেকে দূরে বলে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শারমিনের আসা-যাওয়ার খরচসহ লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহন করা হয়েছে। শিক্ষকদের আস্থা ছিল সে ভালো ফলাফল করবে। সে শিক্ষকদের ভালোবাসার মূল্য দিয়েছে।
শারমিন খাতুনের মা সাজেদা বেগম বলেন, ‘অভাবের তাড়নায় মেয়ে বাল্য বয়সে বিয়ে দিতে গেছিলাম। শিক্ষকেরা বোঝায়, শারমিনও কথা দেয় লেখাপড়া করে সে বড় হবে। এখন দেখছি সেদিন বিয়ে দিলে মস্ত ভুল হয়ে যেত। পরিবারের যত স্বপ্ন এখন তাকে ঘিরেই। তার লেখাপড়ায় সহযোগিতা পেলে ভালো হয়। না খেয়ে থাকলেও তার লেখাপড়া আর বন্ধ করব না।’
উপজেলায় একমাত্র জিপিএ-৫ আছিয়ার
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় এবারের দাখিল পরীক্ষায় একজনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে উপজেলার জারইতলা ইউনিয়নের ধারীশ্বর গ্রামের মৃত আক্কাছ আলীর মেয়ে আছিয়া আক্তার। তবে তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে কঠোর সংগ্রাম। পিতৃহীন সংসারে পড়াশোনার খরচ জোটেনি, পড়তে পারেনি ভালো পোশাকও। তবু অভাবকে জয় করে দরজি কারিগর মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে আছিয়া।
আছিয়ার মা হোসনা আক্তার বলেন, ১২ বছর আগে আছিয়ার বাবা তিন সন্তান রেখে মারা যান। তখন তিনি সংসারের খরচ জোগাতে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় অন্যের বাসায় কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি দরজির কাজ করে সন্তানদের ভরণপোষণ করে যাচ্ছেন। বড় মেয়ে হিসেবে আছিয়া তার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়িতে ছোট দুই ভাইবোনকে দেখভাল করে। এরপরও সে জিপিএ-৫ পাওয়ায় তিনি অনেক খুশি। তবে অভাব–অনটনের মধ্যে পরবর্তী পড়াশোনার ব্যয়ভার নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
আছিয়া আক্তার বলে, মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে সে অনেক খুশি। পড়াশোনা শেষ করে সে সরকারি বড় কর্মকর্তা হতে চায়।
আছিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইবনে তাইমিয়া আইডিয়াল দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. রুবেল মাহমুদ বলেন, ‘একজন এতিম, দরিদ্র ছাত্রী নানা প্রতিকূলতা জয় করে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করায় মাদ্রাসার সবাই খুশি।’
মায়ের দোকানে সহায়তা করে পড়ালেখা
ঘরের সঙ্গে ক্ষুদ্র একটি মুদিদোকান, যা চালিয়ে সংসার চালান মা সুমাইয়া। বাবা আমিনুল ইসলাম কাঠের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পুঁজি না থাকায় তেমন আয়-রোজগার হয় না। আয়ের মূল উৎস দোকানটি মাঝেমধ্যেই চালাতে হয় ছেলে সৌরভ মিয়াকে।
এভাবে কষ্ট করে পড়ালেখা করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সৌরভ। সে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর কবি গোলাম মোস্তফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সৌরভের বাড়ি মনোহরপুর গ্রামে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় সৌরভ। আমিনুল ইসলাম জানান, সংসারে অভাব থাকায় বাচ্চাদের ঠিকমতো পড়ালেখার খরচ দিতে পারেন না। এর পরও সৌরভের পড়ার প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল। সে শত কষ্টের মধ্যেও ঠিকমতো পড়ালেখা করেছে। দোকানে বসে কেনাবেচা করেছে আর বই নিয়ে পড়ালেখা করেছে। প্রাইভেটের টাকা ঠিকমতো দিতে পারেননি।
সৌরভের মা সুমাইয়া ইয়াসমিন জানান, ছেলের ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা করবে। কিন্তু প্রাইভেটের খরচ জোগাড় করতে না পারার আশঙ্কায় মানবিক নিয়ে পড়ালেখা করেছে। এখন একটা ভালো কলেজে ভর্তি করানোর ইচ্ছা বলে জানান।
মনোহরপুর কবি গোলাম মোস্তফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, তাঁরা যতটুকু পেরেছেন সৌরভকে সহযোগিতা করেছেন। একটু সহযোগিতা পেলে সে ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করতে পারবে।
দারিদ্র্য জয় করে সাফল্য
দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেছে যশোরের সাবরিনা তাবাচ্ছুম। সে শহরের মধুসূদন তারাপ্রসন্ন (এমএসটিপি) মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এ বছর মানবিক বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়েছে। মাধ্যমিকে সাফল্য পেলেও উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সাবরিনারা যশোর শহরের ঘোপ এলাকার একটি ছোট্ট বাড়িতে থাকে। তার বাবা মন্টু শেখ পৈতৃক সূত্রে এক কাঠা জমি পেয়েছেন। সেই জমির ওপরে টিনশেডের আধা পাকা বাড়িতে তারা থাকে। সাবরিনার বাবা মন্টু শেখ যশোর পৌরসভার অধীন স্বল্প বেতনে অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে রাস্তায় যানজট নিরসনে কাজ করেন। বাবার সামান্য রোজগারে সাবরিনাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, সাবিনার ছোট বোন মাথায় আঘাত পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে। কয়েক বছর ধরে তাকে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সাবরিনার লেখাপড়ার খরচ, কোচিং ও বাড়িতে টিউটরের বেতন—সব মিলিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়েছেন মন্টু শেখ।
সাবরিনার মা নাসরিন খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট মেয়েটা অসুস্থ। এ জন্য বড় মেয়েটিকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। আমার মেয়ের আইন বিষয়ে লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে মেয়ের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
এ বিষয়ে মধুসূদন তারাপ্রসন্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ খাইরুল আনাম বলেন, ‘সাবরিনা খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী। আর্থিক সংকটের কারণে তার মা–বাবা তাকে ঠিকমতো কোচিং বা টিউটর দিতে পারেনি। দারিদ্র্যকে জয় করে সাবরিনা সাফল্য দেখিয়েছে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঝিনাইদহ, প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ ও যশোর অফিস]