বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পানি মানেই একরাশ তিক্ততার গল্প। নোনাজল, আর্সেনিক দূষণ, নদীর লবণাক্ততার বিস্তার—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিরাপদ পানির সংকটে ভোগেন। খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটজুড়ে চিংড়িঘের, ভাঙন, খরা ও লবণাক্ত নদীর পানি যেন জীবনের স্থায়ী সঙ্গী।
এই বাস্তবতার মধ্যে আন্তর্জাতিক একদল গবেষকের নতুন দাবি যেন উপকূলের বুকেই এক অচেনা আশার ঝরনা বইয়ে দিয়েছে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বহু গভীরে লুকিয়ে আছে দুটি বিশাল মিঠাপানির ভান্ডার। হাজার বছর আগের সেই পানি আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।
গবেষণাটি গত শুক্রবার খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুলনা শহর থেকে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক ভূ-তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রযুক্তি, ম্যাগনেটোটেলুরিক ব্যবহার করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরীণ গঠন পরীক্ষা করেন।
সুন্দরবনে প্যালিও ওয়াটারের দুটি উৎস পাওয়া গেছে। প্যালিও ওয়াটার হলো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জল, যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। এটি প্রাচীন সুন্দরবনের বয়স ও গঠনের ধারণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।ইসমে আজম, সুন্দরবনবিষয়ক লেখক ও গবেষক
গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনার উত্তরের অংশে প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে বিস্তৃত আছে বিশাল এক মিঠাপানির স্তর। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং পানির লবণাক্ততা এত কম যে সরাসরি মিঠাপানি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পানি তৈরি হয়েছিল শেষ বরফযুগে, যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ আজকের তুলনায় প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল। তখন নদীগুলো গভীর উপত্যকা তৈরি করে সমুদ্রের দিকে ছুটে যেত এবং সেই বালুমিশ্রিত নদীপথে প্রবেশ করা বৃষ্টির পানি হাজার বছর ধরে ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকত।
সুন্দরবনের ভেতরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় আরেকটি মিঠাপানির ভান্ডার। এটি আকারে তুলনামূলক ছোট এবং গভীরতাও কম, কিন্তু লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই নিচে যে এ অঞ্চলেও নিরাপদ পানির আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই দুটি ভান্ডারের মাঝখানে আছে একটি প্রশস্ত লবণাক্ত পানির স্তর, যা গঙ্গার প্রাচীন নদীখাত ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে। বরফযুগের পর সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তে শুরু করলে এই এলাকাগুলো লবণাক্ত কাদা-মাটিতে ঢেকে যায় এবং এখন তা স্থায়ী লবণাক্ত স্তর হিসেবে ভূগর্ভে রয়ে গেছে।
গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে, ওপরে নোনাজল আর নিচে মিঠাপানির এত দীর্ঘ স্থায়িত্বের রহস্য লুকিয়ে আছে এলজিএমপি বা লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমাম প্যালেসল নামের এক প্রাচীন কাদামাটি স্তরে। বরফযুগ শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ দ্রুত বাড়ার সময়, উপকূলীয় জমিগুলো ঢেকে যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম দানার কাদামাটি ও শিলাস্তরে। এই স্তর উপরের লবণাক্ত পানিকে নিচে নামতে দেয়নি। ফলে হাজার বছর আগের মিঠাপানি আজও অক্ষত।
গবেষকেরা বলছেন, এখন জরুরি হলো গভীর পরীক্ষামূলক কূপ খনন করে তথ্য নিশ্চিত করা, বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা এবং কোথা থেকে কত গভীরতা থেকে পানি তোলা যায়, তার বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা নির্ধারণ করা। পাশাপাশি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে—বর্ষার পানি ধরে রাখা, খাল-পুকুর পুনঃখনন, লবণাক্ততার বিস্তার ঠেকানো এবং গভীর পানি কেবলমাত্র পানীয় জলের জন্য সংরক্ষণ করা।
সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যেখানে নোনাজল-ঘেরা জীবনই নিয়তি, সেখানে মাটির গভীরে হাজার বছরের পুরোনো মিঠাপানির এই গোপন ভান্ডার মানুষের জন্য সত্যিকারের আশার বার্তা। তবে সেই আলো জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক ও স্থানীয় মানুষের।
সুন্দরবনবিষয়ক লেখক ও গবেষক ইসমে আজম বিজ্ঞানীদের নতুন দাবির গুরুত্ব আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সুন্দরবনে প্যালিও ওয়াটারের দুটি উৎস পাওয়া গেছে। প্যালিও ওয়াটার হলো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জল, যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। এটি প্রাচীন সুন্দরবনের বয়স ও গঠনের ধারণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। আমার লেখা “সুন্দরবননামা” বইয়ে বরফযুগে সুন্দরবনে মানুষের আগমন ও বঙ্গীয় বদ্বীপের গঠন নিয়ে লিখেছি। প্যালিও ওয়াটারের এই সন্ধান সেই পর্যবেক্ষণকে আরও দৃঢ় করেছে।’