
খাবারের ছোট একটি দোকান। কাকডাকা ভোর থেকেই শুরু মানুষের আনাগোনা। সকাল হতে না হতেই রীতিমতো ভিড়। কেউ দোকানে বসে খাচ্ছেন, কেউবা খাবার নিয়ে যাচ্ছেন—এক জমজমাট চিত্র। বলছি যশোরের ‘জলযোগ’-এর কথা। লুচি-ডাল-মিষ্টির জন্য বিখ্যাত দোকানটির বয়স শত বছরের বেশি।
জলযোগের ঠিকানা যশোর শহরের চৌরাস্তা, কোতোয়ালি থানা–সংলগ্ন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সড়কের (রেল রোড) গা ঘেঁষে। দোকানটির লুচি-ডাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকালে গরম–গরম লুচির সঙ্গে পাওয়া যায় ডাল। আর সন্ধ্যায় থাকে লুচির সঙ্গে সবজি। প্রতিটি লুচি সাত টাকা। ডাল ও সবজির প্লেট ১৫ টাকা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে লেগে থাকে খাদ্যরসিকদের ভিড়।
জলযোগে লুচির সঙ্গে নানা পদের মিষ্টির স্বাদও নেওয়া যায়। চমচম, কালোজাম, ক্ষীর চমচম, রসমালাই, ছানার পোলাও, মিহিদানা, পানতোয়া ও দই থাকেই। আর দোকানটির নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ তো দেশজুড়ে প্রসিদ্ধ। শীতের মৌসুমে এই মিষ্টির জন্য একপ্রকার হইচই পড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই সন্দেশ নিতে আসেন।
শুধু খাবারের স্বাদ নয়, জলযোগের সঙ্গে যশোরের পুরোনো স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। পারিবারিক সূত্রে দোকানটির বর্তমান কর্ণধার সাধন বিশ্বাস। কথায়–কথায় বললেন, ১৮৯৩ সালে জলযোগের গোড়াপত্তন হয় তাঁর পূর্বসূরি কালীপদ বিশ্বাসের হাতে। সে হিসাবে বয়স ১৩২ বছর। দোকানের চেয়ার-টেবিলগুলোও বহু বছরের পুরোনো। যদিও সংস্কার হয়েছে, তা-ও খুবই সামান্য।
২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘বহরমপুর ভ্রমণ’ শিরোনামে লিখেছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। এতে তিনি যশোর শহরের চৌরাস্তার একটি দোকানে লুচি-মিষ্টি খাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বিষয়টির কথা তুলতেই সাধন বিশ্বাস বললেন, ‘আমাদের এখানেই এসেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদও এসেছেন একবার। তখন আমি স্কুলে পড়ি।’
যশোর ভ্রমণের সুবাদে জুয়েল আইচ, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, সুবীর নন্দী ও ফকির আলমগীরের মতো গুণী মানুষের পা-ও জলযোগে পড়েছে বলে জানালেন সাধন বিশ্বাস। তিনি নিজ থেকেই বললেন বিখ্যাত উপন্যাস মেমসাহেব-এর স্রষ্টা নিমাই ভট্টাচার্যের কথা। তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় যশোর শহরে কেটেছিল। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করতে তিনি একবার জলযোগে এসেছিলেন।
বিখ্যাত এই মানুষগুলোর জলযোগে আসার কোনো ছবি আছে কি না বা পরিদর্শন বই ব্যবহার করেন কি না—প্রশ্নের জবাবে সাধন বিশ্বাস বললেন, ‘আজকালের মতো তখন তো মুঠোফোন ক্যামেরার প্রসার ছিল না। তাই ছবি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। আর পরিদর্শন বই নিয়ে সেভাবে কখনো ভাবা হয়নি। তা ছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কাজটা আমাদের জন্য একটু কঠিনও। কে কী মনে করেন।’
ছবি না থাকলেও সেসব দিনের সাক্ষী জলযোগে এখনো রয়ে গেছেন। এমনই একজন নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস। জলযোগে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। বললেন, ‘ভালো লাগা আছে বলেই এত দিন আছি।’ ছেলেবেলা থেকে জলযোগের সঙ্গে আছেন সাধন বিশ্বাসও। তাঁর ভাষ্য, গৌরবের সঙ্গে শুরু থেকে জলযোগ যেভাবে চলে আসছে, সেভাবে পরিচালনা করে যেতে পারলেই খুশি তিনি।
সাধন বিশ্বাস-নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন জলযোগে খাবারের জন্য এসেছিলেন শহরের আর এন রোডের বাসিন্দা শুভ বিশ্বাস। তিনি বললেন, ‘বাসায় সকালের নাশতার জন্য আমি প্রায়ই লুচি-ডাল-মিষ্টি নিই। জলযোগের ডালটা স্পেশাল। এই স্বাদ কোথাও পাই না।’ আর স্থানীয় দোকানি মুন্নার ভাষায়, ‘জলযোগের খাবার সকাল-বিকেল নিয়মিত খাই। অভ্যাস হয়ে গেছে, না খেলে ভালো লাগে না।’