
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উঁচু জোয়ারে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভোলা-পটুয়াখালীসহ কয়েকটি এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন উপকূলের বাসিন্দারা।
বরিশালে নদ–নদীর উপচে পড়া জোয়ার আর দিনভর ভারী বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল বুধবার রাত থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয় নদ-নদীর উঁচু জোয়ার। এতে নগরের ব্যস্ততম সদর রোডসহ বটতলা থেকে নবগ্রাম, চৌমাথা, বগুড়া রোড, মুনশি গ্যারেজ ও ভাটিখানাসহ অধিকাংশ এলাকার সড়কে হাঁটুপানি জমে গেছে। এ ছাড়া নগরের পলাপুর, মোহাম্মদপুর বস্তি, ধান গবেষণা এলাকা, রূপাতলী হাউজিং, কালিজিরা, দপদপিয়া এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকে ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা।
রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, রূপাতলী হাউজিং এলাকায় জোয়ার ও বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেছে। রূপাতলী গোলচত্বর এলাকায় ড্রেনেজ–ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধ হয়ে আছে। আশপাশের ময়লা-আবর্জনা এমনকি পয়োবর্জ্য মিশে গেছে পানিতে। পথচারী ও যান চলাচলে মারাত্মক দুর্ভোগ হচ্ছে।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে বরিশাল-ঢাকা নৌপথসহ অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক এবং বরিশাল নদীবন্দরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, বৈরী আবহাওয়ায় নৌবন্দরে ২ নম্বর সতর্কসংকেত থাকায় অভ্যন্তরীণ ১০টি রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকেলে ঢাকা-বরিশাল নৌপথের লঞ্চ চলাচলও বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করা হয়।
বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয় বলছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, গভীর নিম্নচাপটি স্থলভাগ অতিক্রম করলেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
জলোচ্ছ্বাসে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার স্লুইসগেট এলাকায় বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, জোয়ারের উচ্চতা ছিল প্রায় চার মিটার। জেলার মনপুরা উপজেলায় কয়েকটি এলাকায় উঁচু জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) মনপুরা উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, মনপুরায় দমকা হাওয়ার সঙ্গে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক এলাকায় গাছ ভেঙে পড়েছে। উপজেলার দাসেরহাট, রামনেওয়াজ, সোনার চর, লতার চরসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বাঁধ উপচে পানি ঢুকে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া কলাতলীর চর, ঢালচর, কাজীর চর, চর নিজামসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
কলাতলীর চর থেকে বেসরকারি সংস্থার কর্মী ফজলুল হক মুঠোফোনে জানান, অনেকের গবাদিপশু ও খামারের হাঁস ভেসে গেছে। তারা এখন মনির বাজারে একটি দোতলা ভবনে অবস্থান করছেন।
এ ছাড়া বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় সদর উপজেলার ভেলুমিয়া, ভেদুরিয়া ইউনিয়ন, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন, তজুমদ্দিন উপজেলার সোনাপুর, মলংচড়া ইউনিয়ন, মনপুরা উপজেলার কলাতলী ইউনিয়ন ও চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, চর কুকরি-মুকরি ও মুজিবনগর ইউনিয়ন এবং সদর উপজেলার কাচিয়া ও রাজাপুর ইউনিয়নের কিছু অংশ, দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া, ভবানীপুর, চরপাতা ও হাজীপুর ইউনিয়নের কিছু অংশ, তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের অংশ, লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের অংশ, বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর ও সাঁচড়া ইউনিয়নের কিছু অংশসহ ৭৪টি চরাঞ্চলে জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা এসব চরে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে কোনো বাঁধ নেই। নেই পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো আজাদ জাহান বলেন, মনপুরা, তজুমদ্দিন ও লালমোহনে বাঁধ উপচে পানি প্রবেশের কথা শুনেছেন। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীদের বাঁধ সংস্কারের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক চরাঞ্চলের প্লাবিত লোকজনকে নিরাপদে আনার চেষ্টা চলছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে উচ্চ জোয়ার ও ভারী বৃষ্টিতে পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ও চরমন্তাজ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন দ্বীপচর ইউনিয়নের বাসিন্দারা।
চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বিপ্লব হাওলাদার বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে আজ সকাল থেকে বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন আগুনমুখা নদীতে পানি বাড়তে থাকে। বেলা ১১টার দিকে আগুনমুখা নদী লাগোয়া চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের পূর্বপাশের প্রায় ৫০০ মিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে গ্রামগুলোতে। এতে তাঁর ইউনিয়নের ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিকেলে ভাটায় পানি কমলেও জলাবদ্ধতা কমেনি। রাতে আরও পানি বাড়তে পারে।
এদিকে অস্বাভাবিক জোয়ারে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত লাগোয়া নতুন সড়কটি ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলার আন্ধারমানিক নদ ও রাবনাবাদ চ্যানেলের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জোয়ারের পানিতে কলাপাড়া পৌর শহরের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাহির পাশের মাছ বাজার, পুরান বাজার, হেলিপ্যাড মাঠ, বড় কলবাড়ী, গোডাউন ঘাট, বাদুড়তলী এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
কলাপাড়ার খেপুপাড়া ডপলার রাডার স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এ জব্বার শরীফ বলেন, কলাপাড়ায় গত ১৪ ঘণ্টায় ১৪৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪৬ কিলোমিটার। আগামী দুই দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। নিম্নচাপটি পায়রা বন্দর থেকে ২৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবন। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছে বন্য প্রাণী।
বঙ্গোপসাগর–সংলগ্ন সুন্দরবনের দুবলা টহল ফাঁড়ি এলাকা থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। তা ছাড়া সুন্দরবনের শেলার চর টহল ফাঁড়ি–সংলগ্ন নদীতে ভেসে যাওয়ার সময় একটি হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দিনের জোয়ারে সুন্দরবনের সব নদ–নদীতে কয়েক ফুট পানি বেড়েছে। এতে সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। রাতে উঁচু জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো বন আবার প্লাবিত হবে। নিম্নচাপের প্রভাব কেটে গেলে প্রাণিকুলসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমাদের থাকার ঘরের নিচ পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। অল্পের জন্য আমাদের মিঠাপানির পুকুরটি ডুবে যায়নি। তবে এমন দুর্যোগের সময় অপরাধপ্রবণ মানুষেরা সুন্দরবনে ঢোকার চেষ্টা করে। এ জন্য আমরা টহল বৃদ্ধি করেছি।’
নিম্নচাপের প্রভাবে বরগুনার প্রধান পায়রা ও বিষখালী নদনদীর পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বরগুনা সদর উপজেলার অংশে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। দুপুর পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনায় ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে নদীর তীরবর্তী বড়ইতলী, পোটকাখালী, মাঝেরচর, বাওয়ালকারসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
মাঝের চর এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বেড়িবাঁধ না থাকায় আমাদের এই চরে জোয়ারের পানি ঢুকে সব তলিয়ে গেছে। ভাটির টানের পরে ঘরে রান্না শুরু হয়েছে। দিন গেছে যেমন তেমন; কিন্তু রাতে যদি পানি বাড়ে তাহলে আমাদের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।’
পাউবোর বরগুনা কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শওকত হোসেন মেহেরাজ বলেন, নিম্নচাপ ও অমাবস্যার প্রভাবে বরগুনার নদ–নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। বাঁধের বাইরের এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর নেই।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ফরিদপুরে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে শহরের পূর্ব খাবাসপুর, গোয়ালচামট, আলীপুর, অম্বিকাপুর, পশ্চিম খাবাসপুর, কমলাপুর এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ফরিদপুর পৌরসভার অনেক সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন শহরবাসী।
ফরিদপুর আবহাওয়া কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. সামাদুল হক বলেন, আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গত ১১ ঘণ্টায় ফরিদপুরে ১৫৮ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়ার এ অবস্থা আরও দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
বাগেরহাটে নদ–নদীর পানি বাড়লেও বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে বাঁধের বাইরে থাকা নদী তীরবর্তী বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে বাগেরহাট শহরের বেশ কিছু রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। শহরের সাধনার মোড়, ডাকবাংলো ঘাট, লঞ্চঘাট এলাকায় সড়কের ওপর পানি জমেছে।
দুপুরে জোয়ারের সময় পানগুছি নদীর পানিতে ডুবে যায় মোরেলগঞ্জ উপজেলার প্রধান বাজার। স্থানীয় সাংবাদিক মসিউর রহমান বলেন, বেড়িবাঁধ না থাকায় নদীর পানি সামান্য বাড়লেই মোরেলগঞ্জ বাজারসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। ড্রেনেজ–ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ভোগ আরও বাড়ে।
পাউবোর বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী মুঠোফোনে বলেন, জেলার সব নদ–নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে কোথাও বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। বেড়িবাঁধ উপচেও লোকালয়ে পানি ঢোকেনি। জোয়ারের পানির চাপে বাঁধের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও জেলার শরণখোলা উপজেলায় ৫০০ মিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ আছে বলে তিনি জানান।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল ও ফরিদপুর, প্রতিনিধি, ভোলা, বাগেরহাট, বরগুনা, কয়রা ও কলাপাড়া, সংবাদদাতা, পটুয়াখালী]