
সমুদ্রপথে মানব পাচারের জন্য নিরাপদ রুট কক্সবাজার। মৌসুমি বায়ু চলে গেলে শীত শুরুর আগে অক্টোবর মাস থেকে বঙ্গোপসাগর শান্ত থাকে। তখন সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনা বাড়তে থাকে। আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানব পাচার ঠেকাতে যেতে পারে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভা বক্তারা এ কথা বলেন। ‘কক্সবাজারে মানব পাচার ও মানব পাচারসংক্রান্ত বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ( এনজিও) কর্মকর্তারা অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন আদালতে ৪৬২টি মানব পাচারের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা যেমন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, তেমনি পাচারের শিকার পরিবারগুলো মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে। মানব পাচার বেড়ে গেলে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমে আসবে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। মতবিনিময় সভায় মানব পাচারের চিত্র তুলে ধরে জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফ উদ্দীন শাহীন বলেন, কক্সবাজারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১৪ লাখ মিয়ানমার রোহিঙ্গার শরণার্থীদের আশ্রয়শিবির রয়েছে। এ কারণে মানব পাচারের নিরাপদ জোন হিসেবে পাচার চক্রের সদস্যরা কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছে। মানব পাচারের শিকারও বেশি হচ্ছে রোহিঙ্গা মেয়েশিশুরা। জেলার টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার ২১টি পয়েন্ট দিয়ে সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। পুলিশসহ যৌথবাহিনীর অভিযানে পাচারের শিকার লোকজন নিয়মিত উদ্ধার হচ্ছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে পাচারকারীরাও। আগের তুলনায় এখন মানব পাচার কিছুটা কমলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শীতকালে সাগর যখন শান্ত থাকে, তখন মানব পাচার বেড়ে যায়। আবার বর্ষাকালে যখন বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকে, তখন মানব পাচার বন্ধ থাকে। কেন মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত—এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। মানব পাচারকারীদের হালনাগাদ তালিকাও নেই। সাগরে মাছ ধরার ট্রলার আছে পাঁচ হাজার। এসব ট্রলারে জিপিআরএস সিস্টেম স্থাপন এবং ট্রলারের মাঝিদের অনলাইন ডেটাবেজের আওতায় আনা গেলে মানব পাচার অনেকাংশে কমে আসবে।
মতবিনিময় সভায় মানব পাচারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কেস ম্যানেজমেন্ট কো-অর্ডিনেটর সাফায়েত বিন কামাল। তিনি বলেন, কক্সবাজারে মানব পাচার থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। ২০১২ সাল থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৩ বছরে কক্সবাজার জেলাতে ৪৬২টি মামলা হয়েছে। তিনটি পৃথক ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলাগুলো বিচারাধীন আছে। নানা কারণে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।
সাফায়েত বিন কামাল বলেন, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে কক্সবাজারে ৮৬টি মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচারের শিকার লোকজনের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। ২০২৩ সালে সারা দেশে ১৩৭টি মানব পাচারের মামলা নথিভুক্ত করা হয়, যার ৪৪ শতাংশ ভুক্তভোগী কক্সবাজার জেলার। ২০২৪ সালে পাচারের উদ্দেশ্যে ১৫০টি বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় ৬৫৭ জনের বেশি রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।
আইওএম কক্সবাজারের কর্মকর্তা আরাবি মহিউদ্দিন তাহের বলেন, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে গত এক বছরে ৬০০টির বেশি মানব পাচারের ঘটনা (মামলার করার মতো ঘটনা) তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এসবের মামলা হচ্ছে না। আদালতে মানব পাচার মামলার দীর্ঘসূত্রতা, মামলার আপসরফা, অপরাধীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, সাক্ষীর অভাব, অর্থসংকট এর অন্যতম কারণ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রত্যাশীর জেলা কর্মকর্তা রশীদা খাতুন বলেন, মানব পাচার থেমে নেই। মানব পাচারের ঘটনায় সম্প্রতি তিনি ১০টি মামলা আদালতে উপস্থাপন করেছেন। মানব পাচারকরী ও দালালদের আইনের আওতা না গেলে পাচার তৎপরতা বন্ধ করা কঠিন।
সভায় মানব পাচারের করণীয়, মানব পাচার আইন ও মামলা তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. সাজমুল করিম, ফিল্ড অপারেশন কো-অর্ডিনেটর প্রণব কান্তি দাশ, ব্র্যাক কক্সবাজার জেলা সমন্বয়ক অজিত নন্দী প্রমুখ।