পটিয়া থানার ওসির অপসারণ দাবিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায়
পটিয়া থানার ওসির অপসারণ দাবিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায়

চট্টগ্রামের পটিয়ায় আন্দোলন

৯ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ, ওসি প্রত্যাহার

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ৯ ঘণ্টা অবরোধ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নেতা–কর্মীদের লাঠিপেটা করার অভিযোগ এনে এই দাবি জানায় সংগঠনটি। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এতে সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

একই দাবিতে উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) কার্যালয়ের সামনের চট্টগ্রাম নগরের জাকির হোসেন সড়ক বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত অবরোধ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীরা। ওসির অপসারণ দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরে কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছে দুটি সংগঠন।

এর মধ্যে পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূরকে গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পটিয়ার ওসিকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

ওসিকে প্রত্যাহারের পর রাত পৌনে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দাবি এখনো পূরণ হয়নি। ওসির প্রত্যাহার এর শুরু মাত্র। আমরা দাবি করেছিলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর যে পুলিশ হামলা চালিয়েছে, তাকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। তাই আমরা ছাত্র-জনতাকে রাজপথে থাকা ও সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পটিয়ায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের কাছে তদন্তের জন্য সময় চাইছে। আওয়ামী লীগের দোসরদের বেলায় তদন্ত কেন, আমাদের জানা নেই। ওসিকে অপসারণ করা না হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টায় পটিয়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। থানায় নিয়ে গেলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না থাকায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। এ নিয়ে পুলিশ ও নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। পরে রাতেই দুই পক্ষের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের ১৯ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করে উভয় পক্ষ।

এ ঘটনার জের ধরে গতকাল সকালে

পটিয়া থানা ঘেরাও ও ‘পটিয়া ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গতকাল সকাল নয়টা থেকেই থানা ঘেরাও শুরু করেন। পরে খণ্ড খণ্ড মিছিলে এসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। সেখানে স্লোগান দিয়ে পটিয়া থানার ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরের অপসারণ দাবি করেন।

অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জাতীয় যুবশক্তির নেতা-কর্মীরা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম নগরে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি। ডিআইজি কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত জাকির হোসেন সড়ক অবরোধও করেন তাঁরা।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

গত মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে পটিয়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে ছাত্রলীগের দীপঙ্কর দে (২৯) নামের এক কর্মীকে আটক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। পরে তাঁকে পটিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তাঁর নামে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে চায়নি। পরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পুলিশ তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নেয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, দীপঙ্কর দে রাঙামাটি জেলার বনরূপা বাজার এলাকার মৃত গৌরাঙ্গ দের ছেলে। তাঁরা রাঙামাটিতে বসবাস করলেও তাঁদের পৈতৃক নিবাস পটিয়ার সুচক্রদন্ডি ২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। দীপঙ্করকে মঙ্গলবার রাতে মারধর করে থানায় আনা হয়। কিন্তু মামলা ছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে তাঁকে হেফাজতে নেওয়া হয়। গতকাল তাঁকে ৫৪ ধারায় (সন্দেহজনক হিসেবে) আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ কর্মী দীপঙ্করকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরেও পুলিশ মামলা নেয়নি। এ নিয়ে আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পুলিশ তাঁদের ওপর লাঠিপেটা করেন। এতে তাঁদের কয়েকজন আহত হন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক রিদওয়ান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। আমরা বাধ্য হয়ে কর্মসূচি দিয়েছি।’

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিছিল নিয়ে ওই ব্যক্তিকে মারতে মারতে থানার ভেতরে নিয়ে আসেন ২০ থেকে ২৫ জন নেতা–কর্মী। তাঁর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ করার অভিযোগ তোলা হয়। এ সময় তাঁরা থানার ভেতরে একপ্রকার ‘মব’ সৃষ্টি করেন। পুলিশ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন তাঁরা। ওসির কক্ষে ঢুকে হইচই করেন।

এ বিষয়ে পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানায় সে সময় সাতজন রিমান্ডের আসামি ছিল। তাঁরা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মী) ছাত্রলীগ নেতাকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে আসেন। আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তাঁরা থানার ভেতরে ঢুকে চড়াও হয়ে পড়েন। আইনের মধ্য থেকে পুলিশ তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেছে।’

দিনভর অবরোধ, দুর্ভোগ

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সরেজমিনে দেখা যায়, ইন্দ্রপুল এলাকায় পটিয়া মডেল মসজিদের সামনে মহাসড়কে অবস্থান করছেন নেতা-কর্মীরা। সেখানে আন্দোলনকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন। অবরোধে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তবে পরীক্ষার্থী ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

বেলা তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান, সেনাবাহিনী ও র‍্যাব আসে। তাঁরা আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। তবে আন্দোলনকারীরা মহাসড়ক ছেড়ে যাননি।

অবরোধের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন পথচারী ও যাত্রীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, পটিয়ার ইন্দ্রপুল থেকে আমজুরহাট পর্যন্ত সড়ক বন্ধ ছিল। যান চলাচল করতে না পারায় অনেকেই হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। বিকেল ৪টার দিকে আব্দুর রহমান নামের এক বাসচালক জানান, বেলা ১১টা থেকে আটকে আছেন।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মতে, এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার গাড়ি চলাচল করে। ১৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পর্যটনসহ বিভিন্ন কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়ক। দেশের বৃহত্তম পর্যটন শহর কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে যাতায়াতের প্রধান সড়ক হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। পর্যটকের পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়িও চলাচল করে এই সড়ক দিয়ে।

বেলা তিনটার দিকে নগরের খুলশী এলাকায় অবস্থিত ডিআইজি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। পরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ডিআইজি কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত জাকির হোসেন সড়ক অবরোধ শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপির নেতা-কর্মীরা। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব সড়কে এসে অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় নেন। ওই সময় তিনি বলেন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিআইজির আশ্বাসের পর অবরোধকারীরা সড়ক ছেড়ে দেন।