
দুই দিন আগেই পার্বতী রানীর মুখে ছিল অমাবস্যার অন্ধকার। সন্তানসম্ভবা এই নারী বলেছিলেন, ‘আমি পোয়াতি মানুষ, এখন কার বাড়িতে গিয়ে উঠব।’ রাজশাহীর ১৩ পাহাড়িয়া পরিবারের এমন উৎকণ্ঠার খবর প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজ। প্রতিবাদের মুখে তাঁদের ঘর ছাড়তে হয়নি।
এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার পার্বতী সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকের মুখ দেখে খুশি হয়ে পার্বতীর দাদিশাশুড়ি সুখমনি নিজের নামটাই রেখে দেন নবজাতকের নাম হিসেবে। সারা দিনে সেই নামটাই ছড়িয়েছে। এখন পার্বতীর মুখে চাঁদের হাসি।
গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় নিজের বাড়িতেই সন্তানের জন্ম দেন পার্বতী। তখন থেকেই তাঁদের মহল্লায় জড়ো হচ্ছিল মানুষ। রাজনৈতিক কর্মীরা এসেছিলেন তাঁদের খোঁজখবর নিতে। মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষকেরা এসেছিলেন তাঁদের পক্ষে মানববন্ধনে দাঁড়াতে। এই ভিড়ের ভেতরে বাইরের কেউ জানতেই পারেননি, পার্বতীর কোলজুড়ে এসেছে নতুন শিশু।
গতকাল এখানেই খাসি জবাই করে খাইয়ে মহল্লার বাসিন্দাদের ‘বিদায়’ দেওয়ার কথা ছিল। এমন ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে ভেস্তে যায় সে আয়োজন।
গত বুধবার বাড়ির সামনে পার্বতী রানীর সঙ্গে যখন কথা হয়, তখনই তাঁকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। গতকাল সকাল আটটার দিকে তার প্রসবব্যথা ওঠে। স্বামী নিপেন বিশ্বাস নির্মাণশ্রমিক। হাতে টাকা নেই। তাই হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। ভরসা করেন মা-বড়মাদের ওপরেই। বাড়িতেই সন্তানের জন্ম দেন পার্বতী। কথা হয় নিপেন বিশ্বাসের সঙ্গে। জানালেন, এটি তাঁর তৃতীয় সন্তান।
এই মহল্লার ১৬টি পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর পরিবারকে উচ্ছেদচেষ্টার প্রতিবাদ জানাতে গতকাল সকালেই ওই মহল্লায় যান আদিবাসী সংগঠনের নেতা-কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও উন্নয়নকর্মীরা। নবজাতক সুখমনির জন্মের খবর মুহূর্তেই জানাজানি হয়ে যায়। তাঁরা বলতে থাকেন, পরিবারগুলোর উচ্ছেদের কথা ছিল। এমন ঘটনা যদি সত্যিই ঘটত, তাহলে পার্বতীর কপালে কী ছিল, তা ভেবেই উদ্বিগ্ন হন তাঁরা। এখানেই যেন সে বেড়ে উঠতে পারে।
বিকেলে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা ওই মহল্লায় যান। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিন রায়হান বলেন, পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদচেষ্টার বিষয়টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টিতে এসেছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, দলের নেতা-কর্মীরা যেন পাহাড়িয়াদের পাশে থাকেন। পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আগের দিন নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানায় নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলা হয়েছে।
গতকাল রাত সাড়ে নয়টার সময় পাহাড়িয়া মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, ছাগলের ঘরের সঙ্গেই পার্বতীর ঘর। ছাগলের ঘর মাড়িয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতে হলো। মেয়ের কী নাম রেখেছেন, তা জানতে চাইলে বললেন, ‘হাসতে হাসতে আমার দাদিশাশুড়ি সাংবাদিকদের বলল সুখমনি। ওই নামই ভাইরাল হয়ে গেছে।’
পার্বতীর বয়স ২১ বছর। বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তাঁর শাশুড়ি সুমিতা বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। রাত ফরসা হলেই তো আমরা চলে যাব—এ টেনশনে খাওয়াদাওয়া বন্ধ ছিল। নাই কোনো জমিজায়গা। কোন জায়গায় থাকব?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ভালো করে বাড়িঘর করতে দেয়নি। তিন ছেলে ঘরে থাকে আর আমরা বুড়াবুড়ি বাইরে শুয়ে থাকি। দেখেন আমার নাতনি কেমন টিপটিপ করে তাকাচ্ছে। দোয়া করেন যাতে বেঁচে থাকে।’