রফিক আহমেদের নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা ও ইজারা নিয়ে ধানের বীজ উৎপাদনে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা
রফিক আহমেদের নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা ও ইজারা নিয়ে ধানের বীজ উৎপাদনে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা

শ্রমিক থেকে ‘বীজ সুলতান’ রফিক, বছরে ফলান ১৬ টন ধানের বীজ

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার একটি গ্রাম কাবিলপুর। কুমিল্লা নগর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরের গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে আমন ধানের সবুজ হাসি। কয়েকটি জমিতে খুঁটি গেড়ে লাগানো সাইনবোর্ডে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ধানের পরিচিতি। সেখানে সহযোগী কৃষক হিসেবে আছে স্থানীয় রফিক আহমেদের নাম।

রফিকের বাড়ি কোন দিকে জিজ্ঞেস করতেই এক ব্যক্তিকে হাত উঁচিয়ে দেখালেন, ওই যে মাঠের মধ্যখানে টিনের বাড়ি, সেটাই ‘বীজ সুলতান’ রফিকের। রুহুল আমিন নামের ওই ব্যক্তিও একজন কৃষক। তিনি বলেন, এলাকায় রফিক আহমেদের পরিচিতি বীজ সুলতান হিসেবে। কারণ, ধানের বীজ উৎপাদনে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। রফিকের নিজের কোনো জমি নেই, তিনি একজন ভূমিহীন। 

শুনতে একটু খটকা লাগলেও কিছুক্ষণ পরই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। প্রায় দুই দশক আগে ২ কেজি বীজ দিয়ে যাত্রা শুরু করা কৃষক রফিক এখন বছরে উৎপাদন করেন অন্তত ১৬ টন ধানের বীজ। এর মধ্যে তিনি কৃষি বিভাগের ধান গবেষণায় আস্থা অর্জন করে সহযোগী কৃষক হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর মাধ্যমে প্রায় ৫০০ জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছে কৃষি বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর। 

রফিক আহমেদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তিনি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার বাথানিয়া গ্রামের প্রয়াত মো. ইউনুছ মিয়ার ছেলে। অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ১৯৭৮ সালে কর্মসংস্থানের জন্য কুমিল্লার দেবীদ্বারে এসে আড়িখোলা জুট মিলে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের রাজিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। 

কৃষি বিভাগের নতুন কোনো ধান এলে সেটি মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার জন্য রফিক আহমেদকে দেওয়া হয়। তাঁর শেখার আগ্রহ অনেক। তাঁর মতো কৃষক শুধু কুমিল্লায় নয়, সারা দেশেই বিরল। 
বানিন রায়, দেবীদ্বার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা

পরিবারে সচ্ছলতা আনতে রফিক ধার–দেনা করে ১৯৯৪ সালে সৌদি আরবে যান। টাকাপয়সা স্ত্রীর নামেই পাঠাতেন। ২০০০ সালে তিনি  দেশে ফিরলে রাজিয়ার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। রাজিয়া আবার বিয়ে করেন। দুই ছেলেসন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন রফিক। একবেলা খাবারের ব্যবস্থা হলে আরেক বেলা থাকতে হতো না খেয়ে। গ্রামের ফসলের মাঠের মধ্যে অন্যের একটুকরা জমিতে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি টিনের ঘর তোলেন। ২০০১ সালে একই গ্রামের ঝরনা বেগমকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। বর্তমানে প্রথম সংসারের দুই ছেলের একজন মালদ্বীপপ্রবাসী আর ছোট ছেলে দন্ত্য চিকিৎসক। দ্বিতীয় সংসারে তাঁর তিন ছেলে। বর্তমানে তিনি যেখানে থাকেন, সেই জমি কেনার জন্য মালিককে কিছু টাকা দিয়েছেন। পুরো টাকা দিতে না পারায় জমিটি রেজিস্ট্রি হয়নি। 

প্রায় দুই দশক আগে ২ কেজি বীজ দিয়ে যাত্রা শুরু করা কৃষক রফিক এখন বছরে উৎপাদন করেন অন্তত ১৬ টন ধানের বীজ। বর্তমানে তাঁর মাধ্যমে প্রায় ৫০০ জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছে কৃষি বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর। 

২ কেজি ধানের বীজে শুরু

২০০৪ সালের কথা। রফিক শ্রমিক হিসেবে কৃষিকাজ করতে গিয়ে কৃষিকেই ভালোবেসে ফেলেন। একদিন দেখা হয় তৎকালীন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর আগ্রহ দেখে কৃষি কর্মকর্তা তাঁকে ২ কেজি ধানের বীজ দেন। তিনি ৩০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে ওই ধান চাষ করেন। জমিতে ভালো ফলন হয়। এরপর তিনি পুরোদমে কৃষিতে জড়ান। মাড়াই শেষে বীজের জন্য যত্ন করে ধান রেখে দিতেন। ধীরে ধীরে ধানের বীজ সংগ্রহ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। 

১৫ বছর ধইরা রফিক ভাইয়ের কাছ থাইক্যা বীজ নিয়া জমিতে ধান করতাছি। ফলনও ভালাই হইতাছে। শুধু বীজই দেয় না, রফিক ভাই এলাকার কৃষকেরারে ফলন বেশি হওনের লাইগ্যা বুদ্ধি-পরামর্শও দেয়।    
আবদুল মতিন, স্থানীয় কৃষক

রফিক আহমেদ এখন বছরে প্রায় ১৬ টন বীজ উৎপাদন করেন। বর্গা ও ইজারা নিয়ে তিনি প্রায় ৬ একর জমিতে বীজ উৎপাদন করছেন। ভূমিহীন হয়েও বীজের প্রতি তাঁর এই নেশা দেখে কৃষি বিভাগের লোকজন তাঁকে ‘বীজ সুলতান’ বলতে শুরু করেন। এভাবে সবার কাছে তিনি এই নামে পরিচিত হন। 

নতুন জাতের ধানের বীজের প্রতি আগ্রহ বেশি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কৃষক রফিক আহমেদের

ষাটোর্ধ্ব রফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন বীজের প্রতি আগ্রহ বেশি আমার। কৃষি বিভাগ গবেষণা করে নতুন কোনো বীজ করলেই আমি সেটি চাষ করি। যখন দেখি উৎপাদন ভালো, তখন সেটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিই।’ স্থানীয়দের পাশাপাশি দেবীদ্বার, চান্দিনা, মুরাদনগরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকেরা এসে তাঁর কাছ থেকে কম টাকায় বীজ নিয়ে যান। 

ধানকে সন্তানের মতো যত্ন

২০০৮ সাল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় রফিক বাণিজ্যিকভাবে ধানের বীজ উৎপাদন শুরু করেন। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার বীজ ডিলাররা তাঁর কাছ থেকে ধানের বীজ নেন। বিশেষ করে রংপুরের একাধিক বীজ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছ থেকে বীজ নেন, নিজেদের নামে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করেন। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিনা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটও তাঁর কাছ থেকে ধানবীজ সংগ্রহ করে থাকে। তিনি প্রতি কেজি বীজ সরকারনির্ধারিত ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেন। 

ক্ষুধার যন্ত্রণা আজ আমাকে এত দূর এনেছে। তাই দেশের মানুষের ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে যেতে চাই।
রফিক আহমেদ

স্থানীয় কৃষক আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ বছর ধইরা রফিক ভাইয়ের কাছ থাইক্যা বীজ নিয়া জমিতে ধান করতাছি। ফলনও ভালাই হইতাছে। শুধু বীজই দেয় না, রফিক ভাই এলাকার কৃষকেরারে ফলন বেশি হওনের লাইগ্যা বুদ্ধি-পরামর্শও দেয়।’    

রফিক আহমেদের স্ত্রী ঝরনা বেগম বললেন, তাঁর স্বামী জমির ধানকে সন্তানের মতো যত্ন করেন। তিনিও স্বামীকে সহযোগিতা করেন। তাঁরা দুজনে মিলেই ধানের বীজ সংরক্ষণ করেন। মানুষ যখন বলে ভালো ধান হয়েছে, তখন তাঁদের মনটা খুশিতে ভরে যায়। 

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের কৃষক রফিক আহমেদ ড্রাম ও বস্তায় ভরে বীজ সংরক্ষণ করেন

‘বীজ সুলতান’ রফিক কৃষি বিভাগের আস্থা অর্জন করেছেন বলে মন্তব্য করেন দেবীদ্বার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বানিন রায়। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের নতুন কোনো ধান এলে সেটি মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার জন্য রফিক আহমেদকে দেওয়া হয়। তাঁর শেখার আগ্রহ অনেক। তাঁর মতো কৃষক শুধু কুমিল্লায় নয়, সারা দেশেই বিরল। 

রফিক আহমেদ আমৃত্যু এই কাজে যুক্ত থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন। চান সবার জন্য কিছু করতে। তাঁর ভাষায়, ‘ক্ষুধার যন্ত্রণা আজ আমাকে এত দূর এনেছে। তাই দেশের মানুষের ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে যেতে চাই।’