‘বর্ষাকালে জলে সব ভরে ওঠে এবং দুই পাড়ার মধ্যবর্তী জল, পাড়ার জমির সমতলে এসে দাঁড়ায়। তখন নৌকোয় যাতায়াত। গ্রামটি প্রকাণ্ড, কিন্তু এ রকম “গ্রাম্য ভেনিস” আমি আর দ্বিতীয় দেখিনি।’
প্রায় ৭০ বছর আগে শাহজাদপুরের পোতাজিয়া গ্রাম সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছিলেন সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী। তাঁর বাবা বিহারীলাল গোস্বামী পোতাজিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বোলপুরে ইংরেজির অধ্যাপনা করার জন্য ডেকেছিলেন। বিহারীলাল পোতাজিয়া ছেড়ে যাননি।
ইতালির ভেনিস শহরে যেমন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির যোগাযোগের মাধ্যম ডিঙি নৌকা, বর্ষায় পোতাজিয়াও ঠিক ভেনিস হয়ে ওঠে। ‘আর বাকি ছয় মাস এই বিপুল জলরাশি কোথায় সরে যায়। তখন ছোট ছোট টিলার ওপরে গ্রামের পাড়াগুলো দেখায় যেন পশ্চিমের কোনো পাহাড়ে জায়গা। এই গ্রাম থেকে মাইলখানেক দূরে যে নদীটি প্রবাহিত সেটি “চলনবিল” নামে খ্যাত প্রচণ্ড একটি হ্রদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। শীত-গ্রীষ্মে ছোট নদী হলেও বর্ষায় যে রূপ ধরত তাকে পদ্মার চেয়ে ছোট নদী বলা যায় না।’ পরিমল গোস্বামীর লেখা স্মৃতি চিত্রণ পড়ে এভাবেই গ্রামটির শীত-গ্রীষ্মের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন গ্রামের জমিদারপুত্র ফনীন্দ্রনাথ রায়। ১৯৬০ সালের কথাসাহিত্য নামক মাসিকে তা প্রকাশিত হয়েছিল। ফনীন্দ্রনাথ বিহারীলাল গোস্বামীর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তাঁর এই লেখায় তিনি একবার চলনবিলকে ‘ভূমধ্যসাগর বিশেষ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার বলেছেন, ‘নদীগুলোর তীরে ঢেউখেলানো সবুজ মাঠে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা হৃষ্টপুষ্ট গরুতে ভরা বাথানগুলো দেখে আমার আপনা থেকেই মনে পড়ত বিলেতী বইগুলোতে দেখা হল্যান্ডের অনুরূপ ছবি।’
স্মৃতি চিত্রণ বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ১৮টি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৫৮ সালে কলকাতা থেকে জ্ঞান প্রকাশনী তা বই আকারে প্রকাশ করে।
পোতাজিয়ার পাশের গ্রাম বুড়ি পোতাজিয়ায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস হওয়াকে ঘিরে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে পোতাজিয়া গ্রামটি।
পরিমল গোস্বামীর বাড়ি ছিল পাবনা জেলার সাতবেড়ে গ্রামে। তিনি লিখেছেন, ‘১৯১০ সালের গোড়ার দিকে, বাবা ওখান থেকেই আমাকে পোতাজিয়া নিয়ে চললেন হাই স্কুলে ভর্তি করে দেবেন বলে । হঠাৎ এলাম নতুন পরিবেশে। ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস সিক্সে।’ গ্রামের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বর্যাকালে বাড়ির দরজায় আসে নৌকো। স্থানীয় জমিদার অন্বিকানাথ রায় স্কুলের সেক্রেটারি, তাঁদের প্রশস্ত একটা ঘরে ছিল হেড মাস্টারের বাস। এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বড়ই কষ্ট হতে লাগল। রেড়ির তেলের প্রদীপে রাত্রে পড়া। তার সলতে অদ্ভুত। বর্ষাকালে জলে একরকম লতা গাছ হয়, তারই ভিতরের শাঁস, গোল লম্বা এবং শাদা, স্পঞ্জের মতো তেল শুষে নেয়, তাতেই প্রদীপ জ্বলে। গ্রামটিও অদ্ভুত। এক একটা উঁচু জায়গার ওপরে এক একটা পাড়া। এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যেতে হ’লে পাহাড়ের মতো নিচে নেমে কখনো সংকীর্ণ ঢালু পথ বেয়ে, কখনো বা বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে গিয়ে আরেক পাড়ায় আরোহণ।’
বর্ষাকালে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে নৌকায় যাতায়াত। এ প্রসঙ্গে পরিমল গোস্বামী বলেছেন, ‘এ রকম গ্রাম্য ভেনিস আমি আর দ্বিতীয় দেখিনি। এ গ্রামে সাইকেল বা মোটর সম্পূর্ণ অচল। মনে হলো এ আমার নির্বাসন। এ রকম জায়গায় বাবা কেন, এবং কীভাবে এসেছিলেন তা আমি জানি না। তবে এ সময়ের দুবছর আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের একখানি পোস্টকার্ড আমি দেখেছিলাম;
চিঠিখানি এই—সবিনয় নমস্কারপূর্বক নিবেদন, বোলপুর বিদ্যালয়ে ইংরেজি অধ্যাপনার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হইয়াছে। বেতন পঞ্চাশ। বিদ্যালয় গৃহে বাস করিয়া অন্যান্য অধ্যাপকদের সহযোগে ছাত্রদের পর্যবেক্ষণভার লইতে হয়। যদি এ কার্যভার গ্রহণ করা আপনার অভিমত হয়, তবে কতদিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারিবেন জানাইবেন। লোকের অভাবে ক্ষতি হইতেছে অতএব আপনার মত জানাইতে বিলম্ব করিবেন না। আমি ফাল্গুন মাস এখানেই যাপন করিব স্থির করিয়াছি যদি সুবিধামতো আমার সহিত সাক্ষাৎ করা সম্ভবপর হয় তবে সকল কথা আলোচনা হইতে পারিবে। আশা করি ভাল আছেন। ইতি ৫ই ফাগুন ১৩১৪। ভবদীয়, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কার্ডের বিপরীত দিকে ডাক ছাপ, (ইংরেজিতে) ‘শিলাইদহ বিও ১৮ ইএফ ০৮ নদীয়া। ঠিকানা—শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত বিহারীলাল গোস্বামী সমীপেষু। তার নিচে ইংরেজিতে লেখা পোতাজিয়া ব্র্যাকেটে পাবনা লেখা।’ পরিমল গোস্বামী লিখেছেন, ‘এই কার্ডখানা আজও আমার কাছে আছে। এক পয়সা দামের পোস্টকার্ড ১৯০৮ সালে লেখা।’
পরিমল গোস্বামী লিখেছেন, ‘বাবা ১৯০৫ সালে ১লা এপ্রিল প্রথম এখানে হেড মাস্টার হয়ে আসেন। এ চিঠি দেখার পর আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাবাকে, কিন্তু তিনি কী বলেছিলেন মনে নেই, কিংবা হয় তো বলেছিলেন এখানকার দায়িত্ব হঠাৎ ছাড়ি কী ক’রে। ১৯২৩ সালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার অন্য একটি বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বাবার কথা উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন ‘আমি একবার ডেকেছিলাম তাকে, হয় তো যেখানে ছিলেন সেখানকার সবাই তাকে ছাড়তে চাননি। আমি বলেছিলাম—সম্ভবত তাই।’