নদীতে ফুল ভাসাচ্ছেন তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা। আজ সকালে বান্দরবানের শঙ্খ নদীর পাড়ে
নদীতে ফুল ভাসাচ্ছেন তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা। আজ সকালে বান্দরবানের শঙ্খ নদীর পাড়ে

ফুল ভাসিয়ে শুরু হলো বিজু উৎসব, সুন্দর পৃথিবীর প্রার্থনা

পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে আর নতুন বছরকে বরণ করে নিতে চাকমা সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বিজু উৎসব আজ শনিবার শুরু হয়েছে; পাশাপাশি শুরু হয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু উৎসব। উৎসবের প্রথম দিনে নদী, ছড়া, ঝরনাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল ভাসিয়ে সুন্দর পৃথিবীর জন্য মঙ্গল কামনা করেছেন নারী, পুরুষ আর শিশুরা। পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা আগামী কয়েক দিন নানা নামে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসব উদ্‌যাপন করবেন।

খাগড়াছড়ি

আজ ভোর থেকে জেলার নদী, ছড়া, ঝরনাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ‘ফুল বিজু’ শুরু হয়। ফুল ভাসিয়ে সুন্দর পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা করেন চাকমা নারী-পুরুষ ও শিশুরা। নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন-হাদি ও পুরুষেরা ধুতি পরে উৎসবে যোগ দেন।

ভোরে পানছড়ি উপজেলার রাবার ড্যাম এলাকায় চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসাতে ভিড় করেন স্থানীয় চাকমা জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা। তাঁদেরই একজন প্রবীণ মালতী দেবী চাকমা। চার কিলোমিটার দূরে রাঙাপানিছড়া এলাকা থেকে এসেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একসময় সন্তানদের নিয়ে ফুল ভাসাতে আসতাম। এখন বয়স বাড়ায় কষ্ট হলেও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে এসেছি মনের শান্তির জন্য। এবার প্রাণভরে প্রার্থনা করলাম, সবাই মিলেমিশে যেন ভালো থাকতে পারি, পৃথিবী যেন শান্তি থাকে।’

ফুল ভাসাতে আসা এক তরুণী মেমোরি চাকমা বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা মিলে চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসিয়ে আগামী দিনের সুখশান্তি কামনা করেছি। এখানে শত শত নারী-পুরুষ উৎসবে যোগ দিয়েছেন। আমি ও সারা বছর অপেক্ষায় থাকি এ দিনটার জন্য।’

উৎসব দেখতে রাবার ড্যাম এলাকাটিতে ভিড় জমান সমতলের লোকজনও। রাজশাহী থেকে এ উৎসব দেখতে আসা মকবুল হোসেন ও সালমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে একবার রাঙামাটিতে ফুল ভাসানো উৎসব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এবার এসে আবারও মুগ্ধ হলাম।’

সরেজমিনে উল্টাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত চাকমার সঙ্গেও কথা হয়। তিনি বলেন, বিজু আদিকাল থেকেই চলে আসছে। বিজু মানে আনন্দ, হইহুল্লোড়, বিজু মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বিজু মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা।

বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন চাকমারা বিজু পালন করেন। আজ ফুল বিজু, ১৩ এপ্রিল রোববার মূল বিজু, ১৪ এপ্রিল নু’অ বজর বা নতুন বছর, আর পয়লা বৈশাখের পর দিন পালিত হয় ‘গোজ্যেপোজ্যে দিন’ হিসেবে। উৎসবের প্রথম দিনে পূজা-অর্চনা ও বাড়িঘর পরিষ্কার করে সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিনে অতিথি আপ্যায়ন ও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়। তৃতীয় দিনে হাঁস-মুরগি ও পশুপাখিদের খাবার দেওয়া, গরাইয়া নৃত্য ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেওয়া হয়।

কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজুকে বরণ করছে এক শিশু। আজ সকালে রাঙামাটি শহরের কেরানি পার্কের দক্ষিণ এলাকায়

রাঙামাটি

সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রাঙামাটি শহরের রাজবন বিহারে বেইনঘর ঘাটে (কাপ্তাই হ্রদের অংশ) ফুল নিবেদন উৎসবের আয়োজন করে ‘পার্বত্য অঞ্চল আদিবাসী ফোরাম’। শহরের কেরানী পার্ক এলাকায়ও আয়োজন করা হয় পৃথক উৎসবের। এ সময় কাপ্তাই হ্রদে কয়েক হাজার মানুষ ফুল নিবেদন করেন।

বেইনঘর ঘাটের অনুষ্ঠানে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার অতিথি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ফুল বিজু দিনটি পবিত্র, খুশির ও আনন্দের দিন। আজ থেকে বিজু উৎসব শুরু হলো। নতুন বছরে আমরা আশা রাখব, এই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যেন সুখশান্তিতে থাকতে পারে।’

সকালে কেরানী পার্ক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার মানুষ ফুল নিবেদন উৎসবে এসেছেন। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে অংশগ্রহণ করেছেন চাকমা নারী, পুরুষ ও শিশুরা। পাহাড়ের অন্যান্য জনগোষ্ঠী ও সমতলের বাসিন্দারাও উৎসবে যোগ দেন। কাপ্তাই হ্রদের দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলে ফুল নিবেদন উৎসব।

এদিকে কাপ্তাই হ্রদের গর্জনতলী, আসামবস্তি, তবলছড়ি কলেজ গেটসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফুল নিবেদনের উৎসব চলে। এ ছাড়া রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায়ও আয়োজন করা হয় উৎসবের।

বান্দরবান

বান্দরবানেও ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ-বর্ষবিদায় উৎসব শুরু হয়েছে। আজ ভোর থেকেই জেলার সাঙ্গু নদে ফুল ভাসাতে ভিড় করেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ঐতিহ্যবাহী পিনন-হাদি ও গয়নায় সেজে অংশ নেন তাঁরা। এ সময় অতীতের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন বছরের জন্য মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন তাঁরা।

জেলা শহরের রাজার মাঠে বৈসাবি উদ্‌যাপন কমিটির উদ্যোগে ভোরে ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া সকালে আয়োজন করা হয় প্রীতি ফুটবল ম্যাচের। আগামীকাল রোববার শোভাযাত্রা হবে।

সরকার এবার উৎসবের জন্য তিন দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। এতে পার্বত্যবাসীর উৎসবমুখরতা বেড়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বম, পাংখোয়া ও লুসাইরা খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালন করেন।