২০১০ সালে প্রথম আলো মুন্সিগঞ্জের কথিত পীরকে নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল
২০১০ সালে প্রথম আলো মুন্সিগঞ্জের কথিত পীরকে নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল

ফিরে দেখা

ভয়ংকর ‘চিকিৎসা’ দেওয়া সেই ‘ভণ্ড পীর’ এখন শয্যাশায়ী, হাসপাতালমুখী খাসনগরের মানুষ

সর্দি–জ্বর থেকে শুরু করে প্যারালাইজড (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) পর্যন্ত যেকোনো অসুখ হলেই মানুষ যেতেন কথিত ভণ্ড পীরের কাছে। সেখানে ভূত-প্রেত ধরার কথা বলে কখনো খুঁটির সঙ্গে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা, কখনো দুই পা ধরে চরকার মতো ঘোরানো, কখনো ঝাড়ু-লাঠি পেটা, কখনোবা শিশুদের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে চিকিৎসার নামে চলত নির্যাতন।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর ইউনিয়নের খাসনগর এলাকার এই চিত্র নিয়ে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম হয়েছিল ‘ভণ্ড পীর ভয়ংকর চিকিৎসা’। কথিত পীর আমজাদ হোসেন ব্যাপারীর নিষ্ঠুরতার বিবরণ পড়ে সেদিন বহু পাঠক প্রথম আলো কার্যালয়ে ফোন করেন। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ওই দিনই গ্রেপ্তার হন আমজাদ হোসেন, যিনি এলাকায় পরিচিতি পেয়েছিলেন আমজাদ ফকির নামে।

সেই ঘটনার ১৫ বছর পর গতকাল শুক্রবার খাসনগর এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ভয়ংকর সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের মধ্য থেকে কুসংস্কার কেটে গেছে। গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে এখন আর কবিরাজ-তথাকথিত পীরদের কাছে যান না। তাঁদের ভরসা এখন হাসপাতাল ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক। কারাগার থেকে বের হয়ে আর ‘কবিরাজি’তে জড়াননি আমজাদ হোসেনও। বর্তমানে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একসময় খাসনগর গ্রামটি কুসংস্কারে পূর্ণ ছিল। মানুষজন অসুস্থ হলে হাসপাতালে না গিয়ে আমজাদ হোসেনের ডেরায় চিকিৎসা নিতে যেতেন। আমজাদের মতো আরও অনেক কবিরাজও ছিল। কারও কাছ থেকে তেল পড়া, কারও কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে সব রোগ থেকে মুক্তি খুঁজতেন মানুষজন। আমজাদ হোসেনরা তাঁর দলবল নিয়ে চিকিৎসার নামে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে অপচিকিৎসা চালাতেন।

যেমন ছিল সেই ভয়ংকর চিকিৎসা

২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়—

রাতে ভূতের চিকিৎসার জন্য বাড়ির উঠানে আসর সাজিয়েছেন ধূর্ত আমজাদ। ঢোল, খোল, হারমোনিয়ামসহ আছে বাদক দল। বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের মধ্যে সব বয়সের নারী রোগীদের এনে মেঝেতে আছড়ে ফেলা হয়। এরপর চলে উপর্যুপরি লাথি, লাঠিপেটা ও চড়থাপ্পড়। মারধর শেষে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে আমজাদ নিজে নাচেন এবং রোগীদেরও নাচতে বাধ্য করেন।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা। এক নারী এই আসরে আসতে চাইছিলেন না। তাঁকে আমজাদের সহযোগীরা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসেন। পাঁচটি ঢোল, দু–তিনটি খোল, তিনটি হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের মাঝে নারীর চিৎকারের শব্দ হারিয়ে যায়। তাঁকে ফকিরের সামনে এনে আছড়ে ফেলা হয়। এরপর লাথি আর মোটা বেত দিয়ে পেটানো হয়।

এভাবে চিকিৎসার নামে নির্যাতন করতেন কথিত সেই পীর

এরপর যে মেয়েকে আনা হলো, তিনি অবস্থা দেখে নিজেই এলোপাতাড়ি নাচতে শুরু করেন। নাচ শেষে রোগীর কাছে আমজাদের প্রশ্ন, ‘তুই কী চাস?’ কিছুক্ষণ পর নিজেই জবাব দেন, ‘জিন আরও নাচ দেখতে চায়।’ এরপর মেয়েটিকে নিয়ে নাচতে শুরু করেন আমজাদ।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৭১ জন রোগীকে লাথি, বেত্রাঘাত ও আছাড় চিকিৎসা দেওয়া হয়। এঁদের কয়েকজন ওসমান মোল্লার স্ত্রী বৃদ্ধ নূরজাহান, প্রতিবেশী আয়েশা বেগম, চরকুন্দলার মোহাম্মদ লিয়াকতের ছেলে নাজমুল সাত দিন ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁরা কেউই সুস্থ হননি বলে জানিয়েছেন।

সিরাজদিখানের খাসনগর এলাকার সেই কথিত পীর আমজাদ হোসেন অসুস্থ হয়ে ঘরেই থাকেন

চিকিৎসার দৃশ্য দেখতে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে কয়েক শ মানুষ ভিড় করে আমজাদের বাড়িতে। ভিড় বাড়তে থাকলে টাকা সংগ্রহ করতে নেমে পড়েন আমজাদের খাদেম মনজিল, সুরত আলীসহ অনেকে। তাঁরা খরচের জন্য ১০ টাকা, ৫০ টাকা ও ১০০ টাকা করে দিতে বলেন। কেউ বেশি দিলে দিতে পারেন কিন্তু ১০ টাকার কম দেওয়া যাবে না।’

আমজাদের খাদেম মনজিল ওই সময় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এই চিকিৎসায় মারধরের পর শর্ষের তেলই প্রধান ওষুধ। তবে এখন তিনি ডাব, মুরগি ও ডিম পড়া দিতে শুরু করেছেন। সন্তান না হলে ডিম পড়া আর ক্যানসারের জন্য ডাব পড়া দেওয়া হচ্ছে। দেড় মাসের বেশি সময় এই অপচিকিৎসা চলছিল বলে সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে ‘রিকশাচালক থেকে ভণ্ড পীর’ উপশিরোনামে আরও বলা হয়েছিল—আমজাদ জানান তাঁর বয়স ৩৫ বছর। অক্ষরজ্ঞান নেই। প্রায় ১০ বছর কুয়েতে ছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, কিছুদিন আগেও আমজাদ গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতেন। জানতে চাইলে আমজাদ বলেন, ‘তখন কেউ আমাকে ইজ্জত দিত না। অহন পীর মানে।’

অতঃপর মামলা, কারাভোগ

নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার শিকার পুষ্পা রানী ও জরিনা বেগম নামে দুই নারী বাদী হয়ে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি এবং ১৩ এপ্রিল পুলিশ বাদী হয়ে একটি প্রতারণাসহ তিনটি মামলা করেন। মামলায় আমজাদ হোসেন ও তাঁর সহযোগী ১৪ জনকে আমামি করা হয়। সেই মামলাগুলোয় ৬ মাস জেল খাটেন আমজাদ। তাঁর সহযোগী ৪ জন জেলে ছিলেন ৪ মাস। ২০১৩ সালে মামলাগুলো থেকে মুক্ত হন আমজাদেরা। এরপর শুরু করেন সবজি বিক্রির ব্যবসা।

আমজাদ হোসেন এখন শয্যাশায়ী

শুক্রবার সকালে খাসনগর এলাকার আমজাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি ভাঙা দোচালা টিনের ঘর। ওই ঘরে ছোট ছোট দুটি কক্ষ। এক কক্ষে আমজাদ হোসেনের দুই মেয়ে। আরেক কক্ষে আমজাদ হোসেন তাঁর মেজ মেয়ের ছেলেসহ শুয়ে আছেন। ঘরের পাশে নলকূপে হাঁড়িপাতিল ধুচ্ছিলেন স্ত্রী রাশিদা বেগম।

সে সময় কথা বলতে চাইলে তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় বিছানায় উঠে বসেন আমজাদ হোসেন। শারীরিক এবং পরিবারের অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই আমজাদ নিজের ও ঘরের অবস্থা দেখিয়ে কাঁদতে থাকেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, জেল খাটার পর পুলিশের ভয় এবং কবিরাজি চিকিৎসার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ায় কবিরাজি বাদ দিয়ে সবজির ব্যবসা শুরু করেন আমজাদ হোসেন। তবে ২০২৩ সালে স্ট্রোক করেন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় শরীরের বাঁ পাশ এবং বাঁ হাত ও পা। বর্তমানে বিনা চিকিৎসায় দিন পার করছেন। সংসারেও তাঁর দুর্বিসহ অভাব-অনটন।

আমজাদ হোসেনের পাঁচ মেয়ে ও স্ত্রীসহ ৭ জনের সংসার ছিল। বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় বড় তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট দুই মেয়ে (১৫) ও (১২) নিয়ে এখন ৪ জনের সংসার। স্ত্রী রাশিদা বেগমের ভাই ও মেয়েদের সহযোগিতায় কোনোরকমে চলছে আমজাদের সংসার ও ছোট মেয়েদের পড়াশোনার খরচ।

আমজাদ বলেন, ‘কবিরাজি কইরা ভুল করছিলাম। এই জন্য তিনটি মামলা হইছিল। ৬ মাস জেল খাটছি। তিন বছর দৌড়াদৌড়ি কইরা মামলা শেষ করছি। জেল খাটার পর থেইকা সবজি বেইচ্চা কোনোরকমে সংসার চালাইতাম। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে স্ট্রোক করি। এতে আমার এক পাশ প্যারালাইজড হইয়া গেছে। এরপর থেকেই বিছনায় পইড়া আছি। টেকার অভাবে নিজের চিকিৎসা করাইতে পারি না। সংসারে এক বেলা খাওন থাকলে আরেক বেলায় থাহে না। অনেক কষ্টে বাইচ্চা আছি।’

আমজাদ হোসেন একসময় অনেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের ‘চিকিৎসা’ করেছেন, সেই প্রসঙ্গ তুললে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমার মধ্যে কোনো কবিরাজি নাই। আমি ওইসুম ভুল করছি। হেই ভুল যেন আর কেউ না করে। যেকোনো রোগের লাইঙ্গা ডাক্তারের কাছেই যাওন দরকার।’

এ সময় স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, ‘টাকার অভাবে আমার স্বামীর সঠিক চিকিৎসা করাইতে পারতাছি না। মামলায় আমাদের সব শেষ হইছে। সরকারি সহযোগিতা পাইলে স্বামীরে সুস্থ করতে পারতাম।’

বুঝতে শিখেছেন মানুষ

আগে গ্রামগঞ্জে শিক্ষার হার একেবারেই কম ছিল। গ্রামের মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। অসুস্থ হলে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের কাছে যেতেন না বলে জানান খাসমহল বালুচর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. আলী আশরাফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা হেকিম, কবিরাজের ওপর ভরসা রাখতেন। এ জন্য প্রায় সময় রোগের কারণে বিকলাঙ্গসহ প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটত। এখন পড়াশোনার হার অনেক বেড়েছে। গ্রামের মানুষও জ্ঞান–বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছেন। মানুষ সচেতন হয়েছেন। তাঁরা বুঝতে শিখেছেন।

আলী আশরাফ বলেন, মানুষ কবিরাজদের কুচিকিৎসা, ভণ্ডামিতে না পড়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের দিকে ঝুঁকেছে। তবে এখনো কিছু কিছু জায়গায় কবিরাজি চিকিৎসা চলে। সচেতনতার সঙ্গে শিক্ষার মান উন্নত হলে চিকিৎসার নামে ভণ্ডামি একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে আসবে।

শুধু বড় রোগ নয়, ছোট ছোট সমস্যা হলেও সাধারণ মানুষ এখন চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছে বলে জানান সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জামসেদ ফরিদী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে কারও হাত ভেঙে গেলে গাছের লতাপাতা পেঁচিয়ে দিত। জ্বর হলে, প্যারালাইসড হলে জিন-ভূতে ধরেছে বলা হতো। নানা বয়সী অসুস্থ মানুষদের ভণ্ড পীর ও কবিরাজেরা পানি পড়া, তেল পড়া, ঝাড়–ফুঁক, রশি দিয়ে ঝুলিয়ে, লাঠি ও ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে, রোগীদের পেটে লাফিয়ে লাফিয়ে চিকিৎসার নামে ভয়ংকর নির্যাতন করতেন। মানুষ সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা সচেতন হয়েছে। একসময় তারা হাসপাতালে আসতে অনীহা দেখালেও এখন হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা ওই মানুষদের ভরসা হয়েছেন।  

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা বিভিন্ন সভা–সেমিনার করে মানুষকে বিভিন্ন রোগের বিষয়ে সচেতন করছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা মানুষকে বিভিন্ন রোগের ব্যাপারে সচেতন করতে কাজ করছেন। এর ফলে ভণ্ড কবিরাজদের চিকিৎসা থেকে বেরিয়ে মানুষ এখন হাসপাতালে এসে সুচিকিৎসা নিচ্ছেন।