মৌলভীবাজারের হাবিবুরের খেতে ২১ জাতের আলু
একজন অগ্রগামী ও নতুন ফসল চাষে আগ্রহী-উদ্যোক্তা কৃষক হিসেবে তাঁর পরিচিতি আছে। অন্যরা যেখানে নতুন কিছু চাষ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে থাকা লোক। লাভ-ক্ষতি কী হবে, এটা না ভেবেই তিনি গবেষকের মতো নতুন জাতের ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এবার তিনি তাঁর খেতে ২১ জাতের আলুর চাষ করেছেন।
এই উদ্যোক্তা-কৃষক হলেন মো. হাবিবুর রহমান। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগরে।
সম্প্রতি গিয়াসনগরে হাবিবুর রহমানের আলুখেতে গিয়ে দেখা যায়, খেতে নানা বয়সের ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক আলু তোলার কাজ করছেন তিনি। মাটি খুঁড়ে বের করা হচ্ছে নানা আকার ও রঙের আলু। খেতের বেশির ভাগ আলু তুলে ফেলা হয়েছে। অল্প কিছু আলু তোলা বাকি। সন্ধ্যার মধ্যেই সেগুলো তোলা শেষ হয়ে যায়। আলু তোলা শেষে ওজন দিয়ে দেখা হচ্ছে, প্রতি শতাংশে কোন জাতের আলু কত কেজি হয়েছে। উত্তোলন করা গোল, লম্বাটে, লালচে ও হলদেটে আলুগুলো স্তূপ করে আলাদাভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি জাতের সঙ্গে আলাদা করে নামের সাইনবোর্ড লাগানো আছে। পরে স্তূপ করা আলু বাড়িতে নেওয়া হবে। এই আলু খাওয়ার জন্য বিক্রি করা হবে না। উৎপাদিত এই আলু বীজের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। বীজ বাছাই শেষে যা বের হবে, শুধু সেগুলোই খাওয়ার জন্য বিক্রি করা হবে।
এই কৃষি উদ্যোক্তা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন-পুরোনো মিলিয়ে তিনি এ বছর ২১ জাতের আলু চাষ করেছেন। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সরবরাহ করা ১৮টি জাত ছিল। কয়েক বছর ধরে রঙিনসহ বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি ধান চাষ করে আসছেন তিনি। কৃষির নতুন প্রযুক্তি, নতুন জাতের প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁর। গত বছর ১২ জাতের আলু চাষ করেছিলেন। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরের বছর বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ করবেন। সেই চিন্তাভাবনা থেকে এ বছর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতা ও পরামর্শে ১৬০ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছেন।
হাবিবুর রহমান বলেন, এবার আলু বপনের শুরুতেই তাঁকে দুর্যোগে পড়তে হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে আলুর বীজ বপন করার কথা। সে ক্ষেত্রে বৃষ্টির জন্য আলু বপন করেছেন দেরিতে, ডিসেম্বরের শেষ দিকে। একদিকে বিলম্বে বপন, অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে অসময়ে বৃষ্টির দুর্যোগ তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আলুর খেতে দেড়-দুই ফুট পানি জমেছিল। অনেকটা ফসলের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, বৃষ্টির কারণে গাছ মরে গেছে। তাই আলু যতটা বড় হওয়ার কথা, তা হয়নি। তারপরও উৎপাদন ভালো হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর এক শতাংশ জমিতে ১৬০ থেকে ১৭০ কেজি আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশি জাতের আলু হলে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ কেজি হতো। তবে এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টি ছিল। এতে মড়ক ও পোকার উপদ্রব ছিল। ঘন ঘন ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয়েছে। এতে প্রতি শতকে প্রায় ২ হাজার ২০০ টাকার মতো খরচ হয়েছে। তাঁর খেতে চারজন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করেছেন। অনিয়মিত শ্রমিক কাজ করেন ১০ থেকে ১২ জন।
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আলু লাস্টে (সময়ের শেষে) লাগাইছি। এর মধ্যে যা অইছে (হয়েছে), সবগুলোই ভালা অইছে। তবে বারি আলু-৭৮ ও বারি আলু-৪৭ সবচেয়ে ভালো অইছে। গত বছরও এই জাত (বারি আলু-৭৮ ও বারি আলু-৪৭) ভালা অইছিল (হয়েছিল)। সবাইরে বীজ দিছি (অন্য কৃষককে দিয়েছি)। যারারে বীজ দিছি (যাদের বীজ দিয়েছি), সবাই খুশি।’ এবার স্থানীয় ৭০ থেকে ৭৫ জন নতুন জাতের আলু চাষ করেছেন বলে তিনি জানালেন।
আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ১৮টি জাতের আলুর মধ্যে ছিল বারি আলু-২৫ (অ্যাসটেরিক্স), বারি আলু-৪০, বারি আলু-৪১, বারি আলু-৪৬, বারি আলু-৪৭, বারি আলু-৪৮, বারি আলু-৪৯, বারি আলু-৫০, বারি আলু-৫৩ (এলবি-৬), বারি আলু-৬২, বারি আলু-৬৩, বারি আলু-৭৭ (সার্পো মিরা), বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯, বারি আলু-৮৭, বারি আলু-৮৮, বারি আলু-৯০ (এলোয়েট) ও বারি আলু-৯১ (ক্যারোলাস)। এ ছাড়া পুরোনো জাতের আরও তিন প্রকার আলু ছিল তাঁর খেতে।
মৌলভীবাজারের আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল মাজেদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে এলাকার কৃষককে মাঠপর্যায়ে দেখানো, বোঝানোর জন্য আমরা তাঁকে ১৮টি ভ্যারাইটি দিয়েছিলাম। কৃষক তো সবটা করবেন না, যেটা বেশি উৎপাদন হবে, সেটাই করবেন। এটা যেন তাঁরা বুঝতে পারেন। গতবার হাবিবুর রহমানকে ১০টি ভ্যারাইটি দেওয়া হয়েছিল। তিনি বীজ রেখে দিয়েছিলেন। ভালো হওয়ায় কৃষক পর্যায়ে তিনি নিজেই বীজ দিয়েছেন।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, এবার ঘন কুয়াশা, বৃষ্টির বৈরী আবহাওয়ার পরও হাবিবুরের সুন্দর ফসল হয়েছে। উনি একজন ভালো ও আগ্রহী কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই এলাকায় আলু হয়। উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ করতে হবে।’
আরও পড়ুন
-
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তানাজ জিপিএ-৫ পেয়েছে, পরিবারে কান্নার রোল
-
রাফায় অভিযান না চালালে ইসরায়েলকে হামাস নেতাদের বিষয়ে গোপন তথ্য দেবে যুক্তরাষ্ট্র
-
ঢাকা অঞ্চলের হোটেল-রেস্তোরাঁয় মূল্যছাড় পাবেন পুলিশ সদস্যরা
-
ছেলেকে কখন বুকে জড়িয়ে নেবেন, সেই অপেক্ষায় মা
-
বিজেপির আসন বাড়বে কি না, সেই পরীক্ষা হয়ে গেল চতুর্থ দফায়