তিন পুরুষ ধরে বাদ্যযন্ত্র বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িত সংগীত জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল করিমের পরিবার
তিন পুরুষ ধরে বাদ্যযন্ত্র বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িত সংগীত জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল করিমের পরিবার

ব্যক্তির গড়া যে জাদুঘরে আছে কয়েক শ বছরের পুরোনো বাদ্যযন্ত্র

নেত্রকোনা অঞ্চলের জারিগানের শিল্পীরা ছন্দ ও লয় রক্ষার্থে মেকুঁড় ব্যবহার করতেন। যদিও বিশেষ ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলিত নাম মেহুড়। লোকজ পালা ও দলবদ্ধ গ্রামীণ গান বা ঘেটুগানেও এই মেকুঁড় পরা হতো। এই যন্ত্রের এখন তৈরিকারক নেই, ব্যবহারও নেই। এর পরিবর্তে ঘুঙুর ও নূপুর স্থান দখল করেছে। ময়মনসিংহ নগরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এশিয়ান সংগীত জাদুঘরে প্রবেশমুখের হাতের ডান দিকে চলছে এই মেকুঁড় প্রদর্শনী।

ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের মোড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে এশিয়ান সংগীত জাদুঘর

লোকজ বাদ্যযন্ত্র বরাবর তৈরি হয় সহজপ্রাপ্য দ্রব্যাদি দিয়েই। লাউ, কুমড়োর খোল, মাটির হাঁড়ি, কলসি, চামড়া, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদিই ছিল লোকজ বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রধান উপাদান। তবে অন্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে। আর টিকে থাকা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও লোকসংগীতে এখন আর নেই বললেই চলে। ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের মোড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে এশিয়ান সংগীত জাদুঘর।

২০২০ সালে এই সংগীত জাদুঘরের যাত্রা শুরু করেন রেজাউল করিম আসলাম। তবে বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন আরও অনেক আগে থেকেই। তিন পুরুষ ধরেই বাদ্যযন্ত্র বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িত রেজাউল করিমের পরিবার।

সংগীতে ব্যবহারের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি গ্রামোফোন ও ক্যাসেট প্লেয়ারও আছে এখানে

ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ি সড়কে ‘নবাব অ্যান্ড কোং’ নামে রেজাউল করিমের বাদ্যযন্ত্রের একটি দোকান আছে। ১৯৪৪ সালে তাঁর দাদা নবাব আলী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। দাদার পর তাঁর বাবা জালাল উদ্দিন ব্যবসার হাল ধরেন। এখন এ ব্যবসা দেখেন রেজাউল করিম। পুরোনো বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন এসব যন্ত্র। শুধু সংগ্রহ নয়, আগামী প্রজন্মের কাছে এসব যন্ত্র পরিচয় করিয়ে দিতে এবং শিল্পের বিকাশেও কাজ করছে রেজাউল করিমের এই সংগীত জাদুঘর।  

এই জাদুঘরে আছে প্রায় ৬০০ বিরল ও দেশি বাদ্যযন্ত্র

গতকাল শনিবার বিকেলে সংগীত জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। পুরোনো বাদ্যযন্ত্রগুলোর কোনোটি ৩৫০ বছর, কোনোটা ২৫০ বছর, আবার কোনোটা ১৫০ বছরের পুরোনো। একসময় লোকজ বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা নিজ হাতে বানিয়ে সংগীত চর্চা করতেন। কিন্তু এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগর এখন নেই; আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে নেই আদি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও।

সংগীত জাদুঘরটি গড়েছেন রেজাউল করিম আসলাম

এই জাদুঘরে আছে প্রায় ৬০০ বিরল ও দেশি বাদ্যযন্ত্র। এর মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরোনো সারিন্দা আছে ২০টি, সরার আছে ৩০টি, মেকুঁড় আছে ৬০টি, চার ধরনের সেতার আছে ৮টি। এ ছাড়া এসরাজ, সারেঙ্গি, সরোদ, তানপুরা, দোতারা, একতারা, লাউয়া ও নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। সংগীতে ব্যবহারের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি গ্রামোফোন ও ক্যাসেট প্লেয়ার আছে অন্তত ৮০টি, ছোট-বড় রেডিও আছে অন্তত ৪০টি, এলপি রেকর্ড প্লেয়ার আছে ৪০০টির মতো। জাদুঘরের বিভিন্ন কর্নারে সাজানো আছে এসব বাদ্যযন্ত্র।

সংগীত জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র

দর্শনার্থী বাবলী আকন্দ বলেন, ‘এই জাদুঘরে যে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রগুলো আছে, তা আমাদের প্রজন্ম দেখেনি। নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু জানার আছে এই জাদুঘর থেকে।’ আরেক দর্শনার্থী রোদেলা সাহা বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই জাদুঘর দেখতে পারবে এবং যন্ত্রগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে, এটি বড় সুযোগ। জাদুঘরটির পরিসর আরও বাড়ানো দরকার।’

সংগীত জাদুঘর দেখতে ভিড় করেন উৎসাহী দর্শনার্থীরা

জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা ও সংগ্রাহক রেজাউল করিম বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্রের পারিবারিক ব্যবসার কারণে আমাদের দোকানে অনেক পুরোনো বাদ্যযন্ত্র থাকত। এগুলো দেখে সংরক্ষণের চিন্তা মাথায় আসে। আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্ত বাদ্যযন্ত্রগুলো সংগ্রহ করি। মানুষের আগ্রহ দেখে সংগ্রহ দিন দিন বাড়াতে থাকি। শুধু বাদ্যযন্ত্র নয়, পাশাপাশি সংগীতবিষয়ক অন্য যন্ত্রগুলোও জাদুঘরে স্থান দেওয়া হয়েছে।’