
জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত রায়হান মিয়ার (৩০) চিকিৎসা থেমে আছে অর্থাভাবে। এ পর্যন্ত পাঁচবার অস্ত্রোপচার করা হলেও সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারেননি সবজি বিক্রেতা এ তরুণ। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এখন চিকিৎসা তো দূরের কথা, তাঁর ১০ সদস্যের পরিবারের খরচ চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।
রায়হান মিয়া হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার দোয়াখানী মহল্লার বাসিন্দা। গুলিতে আহত হওয়ার আগে তিনি ভ্যানে করে পাড়া-মহল্লায় সবজি বিক্রয় করতেন। আহত হওয়ার পর আর কাজে যেতে পারছেন না। খেয়ে না–খেয়ে চলছে তাঁর সংসার।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা বানিয়াচং উপজেলার এলআর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সমাবেত হয়ে একটি মিছিল নিয়ে উপজেলার নতুনবাজার হয়ে বড় বাজারে যায়। আন্দোলনকারী থানার সামনে দিয়ে যেতে চাইলে স্থানীয় ঈদগাহ এলাকায় পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় মিছিলকারীদের। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে ৯ জন নিহত হন। আহত হন পুলিশসহ দেড় শতাধিক মানুষ।
এ সময় গুলিতে রায়হান গুলিবিদ্ধ হন। একটি গুলিতে পেট ও কোমর ছিদ্র হয়ে যায়। পরে তাঁকে আশপাশের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন উদ্ধার করে প্রথমে হবিগঞ্জ হাসপাতাল এবং পরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে টানা চার মাস চিকিৎসা হয়। চিকিৎসাবস্থায় তাঁর কোমরে ও পেটে পাঁচটি অস্ত্রোপচার হয়। এতে ব্যয় হয় ৫ লাখ টাকা। আহত রায়হান জানান, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে এই টাকার জোগান দেন চিকিৎসায়। কিন্তু চিকিৎসা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। অস্ত্রোপচারের জায়গায় ব্যথা অনুভব করেন। রাত হলে ব্যথায় চিৎকার করে ওঠেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে আরও কিছুদিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বললেও অর্থাভাবে তা চালিয়ে যেতে পারছেন না। যে কারণে বাড়িতে ফিরে আসতে হয় তাঁকে।
রায়হান জানান, ঘটনার দিন ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। মিছিলে গিয়েছিলেন এলাকার মানুষের সঙ্গে। এ মিছিলে হঠাৎ করে একটি গুলি এসে তাঁর কোমরের নিচে বিদ্ধ হয়। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে নিজে হাসপাতালে দেখতে পান। রায়হান বলেন, তিনি দুর্ঘটনার আগে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতেন। এখন আর পারেন না। ছয় মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। অস্ত্রোপচারের জায়গাগুলো এখনো শুকায়নি। সেলাইয়ে ব্যথা অনুভব করেন। রাত হলে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন শরীরে। হাঁটাচলা করতে পারছেন না। আক্ষেপ প্রকাশ করে রায়হান বলেন, ‘আগস্টের ঘটনায় অনেকেই শুনেছি সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু আমি এখনো কোনো সাহায্য–সহযোগিতা পাইনি।’
সরেজমিনে রায়হানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দোয়াখানী গ্রামে টিনশেডের তৈরি একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রায়হান। তিনি চার সন্তানের জনক। স্ত্রী সন্তান ছাড়াও তাঁর বাবা-মা ছোট দুই ভাই রয়েছেন ওই পরিবারে। একমাত্র উপার্জনক্ষম রায়হান এখন বিছানায় শুয়ে আছেন। অর্থাভাবে পড়েছে পুরো পরিবার।
রায়হানের বাবা আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমার ছেলের চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি। যে স্থানে অপারেশন হয়েছে, সেই স্থানে এখনো ব্যথা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার সেরে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে। তার চিকিৎসা চালানো ও ওষুধ ক্রয় করা আমাদের পক্ষ সম্ভব হচ্ছে না। অপর দুই ছেলে সীমিত রোজগার করলেও তা দিয়ে সংসার চলে না। রায়হানের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব। পাওনাদারেরা এখন টাকার জন্য বাড়িতে আসতে শুরু করেছেন।’
এ বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষযটি আমরা জেনেছি। নতুন ইউএনও যোগাদানের পর আমি তাঁকে বিষয়টি জানাব। পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তাঁর চিকিৎসার সহযোগিতা করার চেষ্টা করব আমরা।’