মূলত ৩০ আগস্ট রাতে সংঘর্ষ বাধার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, প্রশাসনের ব্যর্থতা ও প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ দাবি, আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা। চাকসু নির্বাচন আপাতত অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ ও প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। ১২ অক্টোবর ভোটের দিন ঠিক হওয়ার পর প্রার্থী বাছাই, প্রচারণার কৌশল ঠিক করা ও জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টায় শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু ক্যাম্পাস-সংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর ভোটের আলোচনা চাপা পড়ে গেছে।
৩০ আগস্ট রাত সোয়া ১২টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়। একজন ছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। প্রথম দফায় অন্তত ৭০ শিক্ষার্থী আহত হন। রাত প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ৩১ আগস্ট দুপুরে আবার সংঘর্ষ শুরু হলে আহত হয়ে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচটি হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন।
ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ, শহীদ মিনারে অবস্থান ও মশালমিছিল, লাল কার্ড প্রদর্শন; সবকিছুই এখন পদত্যাগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে সীমাবদ্ধ। প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, ছাত্রদল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠন একযোগে আন্দোলন চালাচ্ছে।
ছাত্রসংগঠনগুলো বলছে, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নেই। এত শিক্ষার্থী আহত হওয়ার পরও প্রশাসন ব্যর্থতা স্বীকার করেনি। এই প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে কি না প্রশ্ন রয়েছে।
গত রোববার দুপুরে প্রশাসনকে লাল কার্ড প্রদর্শন করে ছাত্রদল। সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা গোলচত্বর থেকে মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। একই সময়ে ‘অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মনির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা থাকলেও নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুত তাঁরা। নির্ধারিত সময়েই ভোট গ্রহণ করা হবে। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর চলমান যে জটিলতা সেটি নিরসনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তিনি জানান, ইতিমধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তালিকা নিয়ে অভিযোগ জানানো যাবে এরপর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
মূলত ৩০ আগস্ট রাতে সংঘর্ষ বাধার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, প্রশাসনের ব্যর্থতা ও প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ দাবি, আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা। চাকসু নির্বাচন আপাতত অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়। সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসের মেস ও কটেজ খালি হতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে এলাকায় থাকতে পারছেন না। তাঁদের কেউ কেউ আবাসিক হলে গাদাগাদি করে থাকছেন। আবার কেউ কেউ পরিচিতজনের মেসে থাকছেন।
গতকাল রোববার ক্যাম্পাসে ঘুরে ২৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তাঁরা বলছেন, কে প্রার্থী হবে, কার ইশতেহারে কী থাকবে, এসব নিয়ে ভাবার সময় এখনো আসেনি। হল থেকে বের হলেই মারধর বা হামলার ভয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তারপর নির্বাচন। এ ছাড়া এখন প্রার্থীর নাম বা পোস্টার নিয়ে চিন্তা নয়, বরং নিরাপত্তা, হলে থাকার নিশ্চয়তা এবং আহত সহপাঠীর চিকিৎসা নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়বার চাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই নির্বাচনে ভিপি (সহসভাপতি) পদে মো. নাজিম উদ্দিন ও জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে নির্বাচিত হন আজিম উদ্দিন আহমেদ।
উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা বাসা হারিয়ে বিপাকে রয়েছেন। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। ফলে চাকসু নির্বাচন আপাতত সাইডলাইনে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ নুহ বলেন, এত বছর পর এই নির্বাচন হচ্ছে। এটি নিরাপদ পরিবেশেই হওয়া উচিত। এখন ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ছাত্রসংগঠনগুলো টানা আন্দোলন করছে। নারী অঙ্গন সাত দফা দাবি দিয়েছে, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট ছয় দফা, অন্য সংগঠনগুলোও প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি তুলেছে। আন্দোলন মূলত নিরাপত্তা ও প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দিকেই যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে নারী অঙ্গন নামে একটি সংগঠন খোলা চিঠিতে অভিযোগ করেছে, প্রশাসন এক বছরের মধ্যে নারীবিদ্বেষী পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রক্টর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, সান্ধ্য আইন জারি করেছেন এবং নারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছেন। শিক্ষার্থীরা বারবার অনলাইন ও অফলাইনে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
যদিও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো.সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন কাজ করছে। নির্বাচন আয়োজন নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই। ভালো পরিবেশ রয়েছে।
ভোটের প্রস্তুতির শুরুতেই ধাক্কা
১ সেপ্টেম্বর চাকসু নির্বাচনের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল কমিশন। খসড়া তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে চাকসুর ভোটার ২৫ হাজার ৮৬৬ জন। ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে তা ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেই ক্যাম্পাসের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার কারণে অভিযোগ জানানোর সময় ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। অর্থাৎ প্রস্তুতির শুরুতেই ধাক্কা খেল নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী, ১৪ সেপ্টেম্বর মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হবে। মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হবে ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। যাচাই-বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। আর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১২ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
বর্তমান প্রশাসনের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা নেই। এ কারণে পদত্যাগ দাবির আন্দোলন শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বলেই মনে হচ্ছে। এখন আস্থাভাজন শিক্ষকদের সামনে নিয়ে এসে নির্বাচন আয়োজনের দিকেই হাঁটা উচিত। বিতর্কিতদের সরিয়ে দেওয়া উচিত।অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান, সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনের নির্বাচন কমিশনার
১৯৬৬ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। একই সময়ে গঠন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। মূলত শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বেগবান, নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে চালু হয় চাকসু। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়বার চাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই নির্বাচনে ভিপি (সহসভাপতি) পদে মো. নাজিম উদ্দিন ও জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে নির্বাচিত হন আজিম উদ্দিন আহমেদ।
সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান। তিনি সার্বিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রশাসনের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা নেই। এ কারণে পদত্যাগ দাবির আন্দোলন শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বলেই মনে হচ্ছে। এখন আস্থাভাজন শিক্ষকদের সামনে নিয়ে এসে নির্বাচন আয়োজনের দিকেই হাঁটা উচিত। বিতর্কিতদের সরিয়ে দেওয়া উচিত।