গ্রামের নারী কারিগরদের গাঁথা মালা মহাজনের কাছে জমা দিতে যাচ্ছেন যূথী খাতুন। গত বুধবার বিকেলে নাটোরের লালপুর উপজেলার মনিহারপুর গ্রামে
গ্রামের নারী কারিগরদের গাঁথা মালা মহাজনের কাছে জমা দিতে যাচ্ছেন যূথী খাতুন। গত বুধবার বিকেলে নাটোরের লালপুর উপজেলার মনিহারপুর গ্রামে

‘করুণ অভিমানের’ মালা গাঁথেন যূথীরা, জানেন না ফুলের নাম

ফুলের নামই জানেন না যূথী খাতুন (২৫)। সেই ফুলেরই মালা গেঁথে চলেছেন। পাঁচ–ছয় হাত লম্বা একটি মালা গেঁথে পারিশ্রমিক পান এক টাকা। প্রায় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যান মহাজনের বাগানে, নিজের হাতে সংগ্রহ করেন ফুল। এরপর বাড়িতে বসে গাঁথেন মালা।

গ্রামের অন্য নারীরাও মালা গেঁথে যূথীর কাছে দিয়ে যান। বিকেলে তাঁর বাড়ি থেকে এসব মালা সংগ্রহ করেন মহাজন। এরপর ঢাকার শাহবাগ কিংবা কোনো ফুলের দোকানে মুগ্ধতা ছড়ায় তাঁদের গাঁথা মালাগুলো। এরপর হয়তো শোভা পায় কোনো নারী বা তরুণীর খোঁপায়। মালার ফুলের নাম গাজরা বা কাঠবেলি। তবে যূথীরা এ নাম জানেন না। ফুলের নাম নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

উদ্ভিদবিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী, গাজরা ফুলের বাণিজ্যিক নাম কাঠবেলি। তবে এটি আসলে টগর। এই ফুলের সাদা কলি দিয়েই মালা গাঁথা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম গানে গানে বলে গেছেন, ‘ফুল চাই-চাই ফুল-টগর চম্পা চামেলি/ ফিরি ফুলওয়ালী নিয়ে ফুল ডালি/ মল্লিকা মালতী জুঁই বেলি।’ গাজরা, টগর, কাঠ বেলি যে নামেই ডাকি না কেন, মালার কারিগরদের কাছে এর নাম শুধুই ফুল।

যূথী খাতুনের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের মনিহারপুর গ্রামে। গ্রামটির শতাধিক নারী নিজেদের কাজের ফাঁকে ফুলের মালা গেঁথে সংসারে বাড়তি আয়ের জোগান দিচ্ছেন। এ ছাড়া গণ্ডবিল রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কয়েকজন নারী এই কাজের সঙ্গে জড়িত। ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে লালপুর উপজেলায় কাঠবেলি ফুলের চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলার নবীনগর গ্রামের ৮-১০ জন চাষি এই উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরাই আবার মহাজন। এসব বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করেন নারী কারিগরেরা।

মালা গাঁথার জন্য বাগান থেকে ফুল তুলছেন কারিগরেরা

গত বুধবার দুপুরের পর মনিহারপুর গ্রামে দেখা মেলে বিলকিস বানুর। হাতে ফুলের মালা। তিনি জানান, গ্রামের শরীফুল ইসলামের বাড়িতে মালা জমা দিতে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই মহাজন নিয়ে যান। শরীফুলের স্ত্রী যূথী খাতুন গ্রামের নারীদের জমা দেওয়া মালার হিসাব রাখেন তাঁর টালিখাতায় লেখা থাকে সবার নাম ও মালার সংখ্যা। বিকেল চারটার মধ্যে সবাই নিজেদের মালা যূথীর বাড়িতে জমা দেন।

গত বুধবার ২১ জন নারী মালা জমা দিয়েছেন জানিয়ে যূথী খাতুন বলেন, মালা গাঁথার জন্য তাঁদের ফুল ও সুতা দেন মহাজন। শুধু সুচ কিনতে হয়। তিনি মহাজনের এজেন্ট হিসেবে মাসে ৬০০ টাকা বেতন পান। আর প্রতিদিন যতগুলো মালা গাঁথেন, সে অনুযায়ীও টাকা পান।

যূথী খাতুনের কাছে মালা জমা দিচ্ছেন কারিগরেরা

যূথী খাতুনের ভাষ্য, গরমের সময় বাগানে ফুল বেশি আসে, তখন তিনি ১০০টি পর্যন্ত মালা গাঁথতে পারেন। শীত আসছে, ধীরে ধীরে ফুলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তাই এ সময়ে মালাও কম গাঁথা হয়।

মালা তৈরির কারিগর আফরোজ বেগম (৩০) সেখানেই ছিলেন। বললেন, মাসে তিনি মালা গেঁথে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিল তুলেছেন। এই টাকা জমিয়ে একটি ছাগল কেনেন। ছাগলটি পরে ভালো দামে বিক্রি করেন। সংসারের টানাটানির মধ্যে তাঁর স্বামী এনজিও থেকে ঋণ করতে যাচ্ছিলেন। ওই সময় আফরোজের কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। এসব টাকা তিনি স্বামীকে দিয়েছেন, ঋণ করতে দেননি। তাঁর ভাষায়, ‘এই ট্যাকা আমি ছেলে-মেয়েদের পেছনে খরচ করি। ইচ্ছামতো হাত খরচটাও করতে পারি। মালা গাঁইতি এই স্বাধীনতাডা পাইচি।’

এই ট্যাকা আমি ছেলে-মেয়েদের পেছনে খরচ করি। ইচ্ছামতো হাত খরচটাও করতে পারি। মালা গাঁইতি এই স্বাধীনতাডা পাইচি।
আফরোজ বেগম, মালার কারিগর

শাহারা বেগম (৫০) নামের আরেক নারী জানান, ২০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। কষ্টের সংসার চালাতে এখন মালা গাঁথার কাজ করেন।

এর মধ্যে ঠিক বিকেল চারটায় যূথীর মুঠোফোনটি বেজে উঠল। তিনি সব মালা গুছিয়ে মহাজনকে দিতে গেলেন। যূথীর বাড়ির সামনের রাস্তায় পরিচয় হলো মহাজনের সঙ্গে। তাঁর নাম কামরুল ইসলাম, বাড়ি উপজেলার নবীনগর গ্রামে। তিনি জানান, তাঁর ২৫ বিঘা জমিতে ফুলের বাগান রয়েছে। গ্রামে তাঁর মতো আরও ৮–১০ জন বড় চাষি রয়েছেন। তারা প্রতিদিন রাতে নাটোরের বনপাড়া এলাকা থেকে বাসে এসব মালা তুলে দেন। পরে রাজধানীতে পৌঁছালে এগুলো সংগ্রহ করেন শাহবাগের ফুলের দোকানের কর্মচারীরা।

বিকেলে মহাজনকে ফুল বুঝিয়ে দেওয়া হয়

ওই দিন বিকেলে আরও কয়েকজন মালার কারিগরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মহিমা বেগম, সাহারা বেগম, আফরোজা বেগম, আরিফা বেগম, আকলিমা বেগম, মেহেরা বেগম, রহিলা বেগম ও শাহিদা বেগমসহ  কয়েকজন—তাঁদের সবার গল্প প্রায় একই রকম। তাঁরা জানান, আগে একটি মালা গেঁথে পেতেন ৫০ পয়সা। এখন পান এক টাকা। পারিশ্রমিক আরেকটু বেশি করার দাবি জানান তাঁরা।

মালার কারিগরদের দাবির কথা শুনে মনে পড়ল কাজী নজরুল ইসলামের সেই গান, ‘মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান/ মালা করব কারে দান?’ যূথীদের গাঁথা মালায় খানিক অপ্রাপ্তির অভিমানও জড়িয়ে আছে।