
ফেনীর সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া থেকে বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে গেছে। ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে ফুলগাজী উপজেলার কিছু অংশ এখনো পানিবন্দী। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন।
ফেনীতে গত ৮ জুলাই থেকে বন্যার প্রভাব শুরু হয়। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ৩৬টি স্থান ভেঙে সৃষ্ট বন্যায় জেলার দুই উপজেলা পুরোপুরি ও তিন উপজেলা আংশিক আক্রান্ত হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা। দুই উপজেলার তিনটি নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে এখনো লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ফলে বাঁধের কাছাকাছি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরে এখনো সংস্কার কাজ শুরু করতে পারেননি বানভাসি মানুষেরা। স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ভাঙাচোরা গ্রামীণ সড়কগুলো গাড়ি চলাচলের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন। ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম এখনো পানিবন্দী। ওই এলাকার লোকজন ঘরে তালা দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
ফুলগাজীর মুন্সিরহাট ইউনিয়ন থেকে কামাল্লা যাওয়ার সড়কটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কটি সংস্কারে কাজ করছেন একদল স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাসেবকদের দলনেতা আবুল কালাম বলেন, এলাকার স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহ করে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো প্রাথমিকভাবে মাটি ও সুরকি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে।
তিন দিন ধরে ঘর পানিবন্দী থাকায় পাশের একটি উঁচু ভবনের দোতলায় পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আনন্দপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা আক্তার। আজ সকালে তিনি বলেন, এই এলাকার পানিবন্দী মানুষের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি।
একই ইউনিয়নের কালীরহাট এলাকার বৃদ্ধ আবদুল করিম বলেন, গতবারের মতো এবারও তার ঘরটি পানিবন্দী। অতীতে এত বৃষ্টি বা বন্যা হলেও তাঁর বাড়িতে কখনো পানি উঠত না। পানি নামার যে ধীরগতি এতে ঘর থেকে পানি নামতে আরও দু-এক দিন সময় লাগতে পারে।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান জানান, পরশুরামে বন্যায় যাঁদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের ছবিসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য জানানো হয়েছে। উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া বেড়িবাঁধ–সংলগ্ন ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িগুলোর মানুষের জন্য এখনো ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে উপজেলা প্রশাসন।
গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রাথমিকভাবে বন্যার কিছু ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করেছেন। বন্যায় জেলার প্রায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর, হ্যাচারি ও খামার ডুবেছে। প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী ৮ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। অপর দিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বন্যাকবলিত তিন উপজেলায় ৩টি ছাগল, ১টি ভেড়া, ২৩৫টি হাঁস ও ১০ হাজার ৬০০টি মুরগি মারা গেছে। মৃত গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ জানান, পাঁচ উপজেলায় আমন বীজতলা ও বর্ষাকালীন বেশ কিছু সবজির খেত নষ্ট হয়েছে। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর এখনো পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইসমাইল হোসেন বলেন, বন্যায় জেলায় প্লাবিত হয় ১১২টি গ্রাম। পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ফুলগাজীর কিছু স্থান এখনো পানিবন্দী। ফেনী সদর এবং দাগনভূঞার কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে জেলা প্রশাসন থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
পানি নেমে যাওয়ার পর বাঁধের ভাঙন অংশের মেরামত কাজ শুরু হবে বলে জানান ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার। জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় নতুন করে আর কোনো গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন।