আমির হোসেনের বাঁশের তৈরি পণ্য দেশ-বিদেশের শৌখিন মানুষের কাছে নিয়মিতই পৌঁছে যাচ্ছে
আমির হোসেনের বাঁশের তৈরি পণ্য দেশ-বিদেশের শৌখিন মানুষের কাছে নিয়মিতই পৌঁছে যাচ্ছে

আমির বাঁশ দিয়ে বানান খাট–আলনা–সোফা, বিক্রি হয় দেশ–বিদেশে

নার্সারির ব্যবসা ছিল। এতে মোটামুটি দিন চলেছে, সংসার চলেছে। তবে ভেতরে–ভেতরে ব্যতিক্রমী কিছু করার তাগিদ ছিল। সেই তাগাদা থেকেই নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। তখন চোখ পড়েছে বাঁশের দিকে। বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই, ঘরের জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি করলেন কিছু বাঁশের আসবাব-পণ্য। একসময় বাইরের লোকজনের কাছে এই আসবাবের কথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এসব বাঁশপণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে অনেকের চাহিদা পূরণ করতে শখের বাঁশপণ্য তৈরির পরিমাণ বাড়তে থাকে। একটা সময় নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দ ও জীবিকা একাকার হয়ে গেছে এই কাজে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার বড়চেগ গ্রামের একসময়ের নার্সারি ব্যবসায়ী মো. আমির হোসেন (সিরাজ) এখন বাঁশপণ্যের কারবারি, কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা। যেকোনো ঘর সাজাতে, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবের পুরাটাই বাঁশ দিয়ে তৈরি করছেন তিনি। তাঁর বাঁশের তৈরি পণ্য দেশ-বিদেশের শৌখিন মানুষের কাছে নিয়মিতই পৌঁছে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বড়চেগ গ্রামে আমিরের ‘সিরাজ কুটির শিল্প’ নামের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানভর্তি নানা রকম বাঁশপণ্য সাজিয়ে রাখা। এসবের মধ্যে আছে খাট, আলনা, সোফা, ড্রেসিং টেবিল-টুল, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার-টেবিল, আলমারি, ল্যাম্পস্ট্যান্ড, চায়ের ট্রে, ফুলের টবসহ বিভিন্ন ধরনের শোপিস। সবটাই বাঁশ দিয়ে বানানো।

আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রমী কিছু করার প্রতি আমার আগ্রহ। একটা সময় মনে হলো, কাঠ দিয়ে যদি আসবাব হয়, তাইলে বাঁশ দিয়ে হবে না কেন! শখে শখে নিজের ধারণা, চিন্তাভাবনা থেকে ঘরের জন্য বাঁশ দিয়ে কিছু জিনিস তৈরি করলাম। এর মধ্যে ছিল খাট, সোফা, টিভি র‌্যাক ইত্যাদি। তা দেখে মানুষ আগ্রহ দেখায়। মানুষের আগ্রহ পূরণ করতে গিয়ে এখন এটাই আমার জীবিকা, এতেই আনন্দ পাই।’

এখন খাট, আলমারি, আলনা, চেয়ার–টেবিল, সোফাসহ আমির হোসেন অর্ধশতের বেশি নকশার পণ্য বানান

আমির হোসেন বলতে থাকেন, ২০০০ সালের দিকে ঘরের জন্য কিছু বাঁশের আসবাব তৈরি করেন তিনি। ধীরে ধীরে তাঁর সেই আসবাবের কথা দশ কান হয়ে অনেকের কাছে পৌঁছে যায়, মানুষ দেখতে আসেন। কেউ বানিয়ে দেওয়ার আবদার করেন। বাঁশের পণ্য তৈরিতে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। নিজে থেকেই সব কলাকৌশল আয়ত্ত করেছেন। শৌখিন মানুষের চাহিদামতো বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নার্সারির ব্যবসা থেকে কিছুটা সরতে থাকেন, ঝুঁকে পড়েন বাঁশপণ্য তৈরিতে। ২০০৫ সাল থেকে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে গেলেন বাঁশপণ্যের কারবারিতে।

শুরুটা একটু কঠিনই ছিল জানিয়ে আমির হোসেন বলেন, ক্রেতারা আসতেন, গাড়ি থামিয়ে দেখতেন। কিন্তু কিনতেন না। বাঁশের তৈরি পণ্য কতটা মজবুত হবে, পোকায় ধরবে কি না, ভেঙে যাবে কি না—এসব নিয়ে ক্রেতাদের অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। ক্রেতারা বাঁশের পণ্যের ওপর ভরসা করতে পারতেন না। এর মধ্যে টুকটাক যাঁরা কিনে নিতেন, তাঁদের মাধ্যমে পণ্যের স্থায়িত্ব সম্পর্কে জানাজানি বাড়তে থাকে। আগের ক্রেতারাই নতুন ক্রেতা বাড়িয়েছেন। ২০১০ সালের পর থেকে ক্রেতার পরিধি বাড়তে থাকে। ক্রমে তা সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

আমির হোসেন শুরুতে নিজেই পণ্য বানানোর কাজ করতেন, এখন নয়জন কারিগর আছেন

এখন খাট, আলমারি, আলনা, চেয়ার-টেবিল, সোফাসহ আমির হোসেন অর্ধশতাধিক ডিজাইনের পণ্য বানান। শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন এলাকার রিসোর্ট সাজাতে তাঁর তৈরি পণ্য ব্যবহার করা হয়। তিনি নিজে গিয়েও সাজিয়ে দিয়ে আসেন। বৃহত্তর সিলেট ছাড়াও সরাসরি ও অনলাইনে যোগাযোগ করে প্রবাসীসহ অনেকেই এখন তাঁর কাছ থেকে বাঁশপণ্য কিনছেন। চট্টগ্রাম, মোংলা, শরীয়তপুর, বগুড়া, মেহেরপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ দেশের নানা স্থানে সিরাজ কুটির শিল্পের পণ্য যাচ্ছে।

আমির হোসেন জানান, শুরুতে নিজেই পণ্য বানানোর কাজ করতেন। এখন তাঁর কারখানায় নিয়মিত-অনিয়মিত নয়জন কারিগর আছেন। কেউ বাঁশ প্রক্রিয়াজাত করেন, কেউ আসবাব তৈরি করেন। একেকজন কারিগরের মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৬ হাজার টাকা। তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখে তাঁরা কারিগর হয়ে উঠেছেন। একটি খাট তৈরি করতে বাঁশসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। একটি সোফায় খরচ হয় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে স্থানীয় বিভিন্ন গ্রাম থেকে বরুয়া, মাকাল, বেতুয়াসহ বিভিন্ন জাতের বাঁশ কিনে থাকেন তিনি। সেই বাঁশ একদফা শুকানো হয়। তারপর ৭২ ঘণ্টা ওষুধমিশ্রিত পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। ১৫ দিনের মতো আবার শুকিয়ে বাঁশকে ‘সিজন’ বা ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়। কিছু পণ্য প্রস্তুত করা থাকে, যাতে ক্রেতা চাওয়ামাত্র সরবরাহ করা যায়। কিছু পণ্য তৈরি করেন ক্রেতার চাহিদামতো। একটি পণ্যের ১২ বছরের ‘ওয়ারেন্টি’ থাকে। এই সময়ের মধ্যে ক্রেতার কোনো অভিযোগ থাকলে পাল্টে দেওয়া হয়।

এই ব্যবসা করে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমির হোসেনের সংসার ভালোভাবেই চলে। মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। আরও নতুন নতুন পণ্য তৈরি করে তিনি আনন্দ কুড়াতে চান, চান ক্রেতার মনেও আনন্দ দিতে।