দেড় বছর বয়সী শিশু জাবেদকে বারান্দায় বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন মিনা আক্তার। শিশুটির বাবা সাগর মিয়া তখন বাড়ির বাইরে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে জাবেদকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন মিনা। পরে বাড়ির পাশে পুকুর থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত রোববার নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার পোগলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। তার দুই দিন আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে একই উপজেলার সালেঙ্গা গ্রামে ডোবার পানিতে ডুবে দুই বছর বয়সী শিশু জারিফের মৃত্যু হয়।
শুধু জাবেদ ও জারিফই নয়, নেত্রকোনায় পানিতে ডুবে গত সাড়ে ৪ বছরে ২৭১টি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে গত ১ বছর ৩ মাসে ৩২ জনের মৃত্যু হয়। চলতি মাসের ১ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত অন্তত আটটি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। শুধু কলমাকান্দাতেই দুই সপ্তাহে সাতটি শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। মারা যাওয়া শিশুদের বয়স ১৮ মাস থেকে ১১ বছরের মধ্যে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত প্রথম আলোর সংবাদ, হাসপাতাল ও পুলিশের দেওয়া হিসাব বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নেত্রকোনার ১০টি উপজেলার মধ্যে কলমাকান্দায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। গত ১ বছর ৩ মাসে যে ৩২ শিশু মারা গেছে, তার ১৯ জনই কলমাকান্দার। বাকি ১৩ জনের মধ্যে সদরে ৪ জন, কেন্দুয়ায় ৩ জন, আটপাড়া ও পূর্বধলায় ২ জন করে এবং মোহনগঞ্জ ও মদনে ১ জন করে মারা গেছে। ২০২৩ সালের মে, জুন ও আগস্টে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি ৪১টি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে মে মাসে কলমাকান্দায় ৯ শিশুসহ ১৯ জনের মৃত্যু হয়। আর জুনে ১১, জুলাইয়ে ১৩ ও মে মাসে ৯ শিশুর মৃত্যু হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মারা যাওয়া শিশুদের বয়স দেড় থেকে ১১ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগ শিশুই বাড়ির সামনে, পাশে বা পেছনের গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, পুকুর, ডোবা বা নদীতে ডুবে মারা গেছে। মৃত্যুর ঘটনাগুলো সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বেশি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরের লোকজন কাজে ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে মায়েরা উঠানে বা বারান্দায় শিশুকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখে রান্না বা গৃহস্থালির কাজ করেন। এ সময় শিশুরা কোথায় যাচ্ছে, কোথায় খেলছে, অনেক সময় তা খেয়াল করেন না তাঁরা। আর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়ে যখন পরিবারের সদস্যরা বিশ্রাম নেন, তখন শিশুরা খেলতে বের হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। জেলায় যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের।
৪ বছরে ২৭১ শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি উদ্বেগজনক বলছেন স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন। তাঁরা এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি ও ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানোর ওপর জোর দেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কথা বলছেন।
জেলা নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক হারাধন সাহা বলেন, কমিউনিটি সচেতনতা ছাড়া কোনো পথ নেই। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ ও প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। জেলায় সাঁতার শেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। মদন, মোহনগঞ্জ ও দুর্গাপুরে সাঁতার শেখানোর জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে বলে শুনেছেন, কিন্তু সেটা নামমাত্র। অনেক উন্নত দেশে বিদ্যালয়ে সাঁতার শেখানো বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোতেও নির্দিষ্ট বয়সে সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত।
পানিতে ডুবে যেসব শিশু মারা যায়, তাদের প্রায় সবাইকেই মৃত্যুর পর হাসপাতালে আনা হয় বলে জানান চিকিৎসকেরা। কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তাঁর উপজেলায় বর্ষাকালে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। সাঁতার না জানা, প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান না থাকা, সচেতনতার অভাবে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। তিনি বলেন, কেউ ডুবে গেলে তাকে উদ্ধারের পর তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার যেসব প্রাথমিক উদ্যোগ আছে, তা অনেকেই জানেন না। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বিষয়টি শেখানো হচ্ছে। ডুবে যাওয়া শিশুর মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে এবং হৃৎপিণ্ড বরাবর এক ইঞ্চি পর্যন্ত দেবে যায় এমনভাবে চাপ দিতে হবে।
জেলা ও পুলিশ প্রশাসন ব্যাপারে গণসচেতনা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, পানিতে ডুবে এত শিশুর মৃত্যু খুবই উদ্বেগজনক। মৃত্যুর প্রধান কারণ অসতর্কতা ও যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাব। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন কাজ করছে।
নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম বলেন, পানিতে ডুবে এত শিশুর মৃত্যু তাঁদের ভাবাচ্ছে। কমিউনিটি সচেতনতা ছাড়া কোনো পথ নেই। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর পুলিশ সেখানে যায় এবং সচেতনতা বাড়াতে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে। বিট পুলিশিংসহ যেকোনো সভা-সেমিনারেও এ নিয়ে কথা বলে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।