ছিমছাম টিনের ঘর। বসার ঘরে বসেছিলেন মনজু আরা বেগম (৪২)। চারপাশজুড়ে নীরবতা। মনজু আরার হাতে একটা বাঁধানো ডায়েরি। সেটির পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখ মুছছিলেন তিনি। ডায়েরির পাতা স্পর্শ করে দেখেন। ডায়েরি ছুঁয়েই তিনি যেন মেয়ে সুমাইয়া জান্নাতকে (২০) অনুভব করেন। গত ২৩ জুলাই ডেঙ্গু জ্বর তাঁর কাছ থেকে মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। পুরো ঘর মাতিয়ে রাখা মেয়েটি এখন কেবল ডায়েরির পাতায় বেঁচে আছেন। নিজের সব কথা এখানেই লিখে রাখতেন তিনি।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পুরোনো থানা গেটের রশিদের পাড়া এলাকায় মনজু আরা বেগমের টিনের ঘর। বড় মেয়ে সুরাইয়া হাসনাতের বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে। ছোট দুই মেয়ে সামিরা জান্নাত দশম ও সোবাহা হাসনাত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই দুই মেয়ে নিয়ে মনজু আরা এখানে থাকেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মেজ মেয়ে সুমাইয়ার মৃত্যুর পর গত তিন মাসে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। মনজু আরার কোনো পুত্রসন্তান নেই। দুই বছর আগে হৃদ্রোগে মারা গেছেন স্বামী হামিদ হোসেন।
উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ঘরেই ব্যাচ করে শিশুদের পড়াতেন সুমাইয়া। যা আয় হতো পুরোটাই সংসারের খরচের জন্য দিয়ে দিতেন। গত ২০ আগস্ট বিয়ের দিন ধার্য ছিল মেয়েটির। কিন্তু সংসার করা হলো কই।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, চট্টগ্রামে এ বছর এখন পর্যন্ত ২০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সাতজন মারা গেছেন জুলাইয়ে। সুমাইয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে ডেঙ্গু জ্বরের পাশাপাশি ফুসফুসে পানি আসাসহ নানা কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সুমাইয়ার লেখার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনজু আরা। তিনি বলেন, ‘বাড়ির সব কাজ সে আনন্দের সঙ্গে করত। বাসায় কয়েকজন শিশুকে পড়িয়ে মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা পেত। পুরোটাই আমার হাতে দিয়ে দিত। রান্না করে মানুষকে খাইয়ে বেশি আনন্দ পেত সে। বাড়িতে মেহমান এলে খুশি হতো। নিজের হাতে নানা ধরনের নাশতা বানিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করত। সে চলে যাওয়ায় আমাদের পুরো বাড়িটিই অন্ধকার।’
রশিদের পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত জুলাইয়ের শুরুতে রশিদের পাড়া এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই মাসের মাঝামাঝি একসঙ্গে পরিবারটির পাঁচ সদস্য মনজু আরা, তাঁর বড় মেয়ে সুরাইয়া, মেয়ের জামাই শেখ আহমদ, মেয়ে সুমাইয়া ও সামিরার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। অন্যরা সেরে উঠলেও আর পেরে ওঠেননি সুমাইয়া। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, চট্টগ্রামে এ বছর এখন পর্যন্ত ২০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সাতজন মারা গেছেন জুলাইয়ে। সুমাইয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে ডেঙ্গু জ্বরের পাশাপাশি ফুসফুসে পানি আসাসহ নানা কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মনজু আরা জানান, ২০২৩ সালে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন সুমাইয়া। তবে স্নাতকে ভর্তি হননি। আগস্টের ২০ তারিখ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাঁর। বিলাপ করতে করতে মনজু আরা বলেন, ‘ভোরে জেগে উঠত মেয়ে। উঠেই ঘর মোছা, রান্নাবান্না ও পরিবারের সবার জন্য নাশতা তৈরিসহ যাবতীয় কাজ শেষ করত। কাজ শেষে আমাকে ডাকত। মেয়ের ডাকে প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙত। এখন আর ঘুম ভাঙার তাড়া নেই।’