
দুপুরের কড়া রোদ আর ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। এমন অবস্থার মধ্যেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকসংলগ্ন সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন হরিচরণ দাস (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ। তাঁর মাথায় রংচটা একটি ছাতা, যা সামনের ঠেলাগাড়ির এক পাশে বাঁধা। আর গাড়ির প্রায় পুরোটায় সাজানো আছে কলা। জানতে চাইলে মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, ‘কষ্ট কইরা কলা বেইচ্যা সংসার চালাইয়া আইরাম।’
সম্প্রতি এক দুপুরে হরিচরণের সঙ্গে কথা হয়। হরিচরণ বলেন, চার দশক ধরে তিনি কলা বিক্রি করেন। যা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসার।
আলাপে আলাপে হরিচরণ জানান, তাঁর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রায়পাড়ায়। প্রথম দিকে টুকরিতে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কলা বিক্রি করতেন। পরে আসেন সুনামগঞ্জ শহরে। সেখানে ফেরি করে কলা বিক্রি করেছেন। প্রায় ১২ বছর আগে একখানা লোহার ঠেলাগাড়ি জোগাড় করেন। তখন থেকেই এই গাড়িতে করে কলা বিক্রি করছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় হরিচরণ পাড়ি জমান সিলেটে। পরিচিত এক দোকানদারের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে ঠেলাগাড়িতে কলা বিক্রি শুরু করেন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
হরিচরণ বলেন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক। তাঁরা দরদাম বেশি করেন না। যার যা ইচ্ছা দেন, অনেক সময় কম দিলেও কিছু বলেন না তিনি।
হরিচরণের প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার কলা বিক্রি হয়। বিক্রির টাকা থেকে ৮-৯ দিনের জন্য একবারে ২০-২৫ হাজার টাকার কলা কেনেন। সেগুলো ঠেলাগাড়িতে সাজিয়ে বিক্রি করেন প্রতিদিন। এই আয় থেকে সংসার চালানো, ওষুধপত্র কেনাসহ প্রায় সবটাই করেন তিনি।
হরিচরণের এক ছেলে ও তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। ছেলে প্রায়ই তাঁকে কাজ করতে মানা করেন। তবে সেই বারণ শোনেন না তিনি। এ বিষয়ে হরিচরণের ভাষ্য, ‘ছেলে কইব, তুমার অখন কাজ করন লাগত না। কিন্তুক আমি তো জানি, আমার কাম ছাড়া সংসার চলত না। এই ঠেলাগাড়িটাই আমার জীবন। যত দিন বাঁইচ্যা আছি ব্যবসা চালাইয়া যাইমু।’
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন হরিচরণ। এই বিক্রেতার কাছ থেকে নিয়মিত কলা কেনেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আঙ্কেল (হরিচরণ) আন্তরিক। কখনো দাম নিয়ে ঝামেলা করেন না। বরং আমরা বেশি টাকা দিলে হাসিমুখে বলেন, “থাক, থাক, ঠিক আছে।”’
হরিচরণের প্রশংসা করেন পাশের দোকানদারেরাও। তাঁদের মধ্যে ইমন হোসেন নামের একজন বলেন, হরিচরণ খুব পরিশ্রমী মানুষ। তাঁর কারও সঙ্গে কখনো ঝামেলা হয় না। নিজের মতো করে ঠেলাগাড়িতে করে কলা বিক্রি করেন। তিনি সবার সঙ্গেই আন্তরিক।