কোদালীছড়া দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আজ রোববার সকালে মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোড সংলগ্ন এলাকায়
কোদালীছড়া দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আজ রোববার সকালে মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোড সংলগ্ন এলাকায়

বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার শহরে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা

টানা ও ভারী বর্ষণে মৌলভীবাজার শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না। অনেকগুলো সড়ক তাৎক্ষণিক পানিতে ডুবেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার দোকান ও বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে নিচু এলাকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পথচারীকে। বৃষ্টির পানি সরে যেতে সময় লাগছে। এক দিন পরও নিচু এলাকায় পানি থেকে যেতে দেখা গেছে; সঙ্গে আছে ধারাবাহিক বৃষ্টি।

মৌলভীবাজারে গতকাল শনিবার প্রায় সারা দিন থেমে থেমে ভারী বর্ষণ হয়েছে। এতে শহরের অনেকগুলো প্রধান ও অলিগলির সড়ক নালার পানিতে ডুবে যায়। পূর্ব গির্জাপাড়াসহ নিচু এলাকার অনেক বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। অনেককে বাসাবাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এই জলাবদ্ধতার কারণ ভারী বর্ষণ, নালাগুলোয় ইচ্ছেমতো ময়লা–আবর্জনা ফেলে ভরাট করা।

শহরের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম কোদালীছড়ার ভাটির দিকে বিভিন্ন স্থানে শুকনা মৌসুমে সেচের জন্য বাঁধ দেওয়া। মাছ ধরার জন্য ফাঁদ পেতে রাখাসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব কারণে কোদালীছড়া দিয়ে পানি দ্রুত প্রবাহিত হতে পারছে না, শহরে বৃষ্টির পানি ফুলে–ফেঁপে উঠেছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরছিল। বিকেল থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে থাকে। শুরু হয় ভারী বর্ষণ। বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যেতে পারেনি। শহরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হতে থাকে জলাবদ্ধতা। শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের বিভিন্ন স্থান, শান্তিবাগ স্কুল রোড, সৈয়দ মুজতবা আলী সড়ক, কাশীনাথ রোড, লক্ষ্মীবালা স্কুল রোড, পূর্ব গির্জাপাড়া সড়ক, টিবি হাসপাতাল সড়ক, পশ্চিমবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। পূর্ব গির্জাপাড়া এলাকায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি হয়েছে। অনেক বাসার ভেতর পানি ঢুকে যায়। অনেককে বাসা ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, প্রচুর বৃষ্টির কারণে এই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এত বৃষ্টি ধারণ করার মতো জলাধার শহরে নেই। অন্যদিকে পানিনিষ্কাশনের যেসব নালা আছে, সেই নালাগুলোর একসঙ্গে এত পানি টেনে নেওয়ার সক্ষমতা নেই। এ ছাড়া একটা সময় শহরের পূর্বাঞ্চলে ফাটাবিলের বিশাল এলাকা অনেক পানি ধারণ করতে পারত। আশপাশের বৃষ্টির পানি দ্রুত ফাটাবিলে এসে জমাট হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ফাটাবিলের সেই প্রকৃতি–পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। নিচু এলাকা ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বাসাবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে একদিকে জল ধারণের জায়গা কমে গেছে। অন্যদিকে পানিনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। এতে পানি ফুলে–ফেঁপে উঠছে।

ফাটাবিল এলাকায় জলাবদ্ধতা। রোববার সকালে মৌলভীবাজার শহরের টিবি হাসপাতাল সড়ক-সংলগ্ন এলাকায়

শহরের বিভিন্ন নালায় (ড্রেন) নিজেদের খুশিমতো ফেলা হচ্ছে পলিথিনসহ ময়লা–আবর্জনা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নানা রকম বর্জ্য এসব নালার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। আবাসিক এলাকার লোকজনও বাসাবাড়ির বর্জ্য নালার মধ্যে ছুড়ে ফেলছেন। এতে নালা ভরাট হয়ে উঠছে। এতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানি নালা উপচে সড়কের ওপর চলে আসছে। নিচু বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। এ ছাড়া কোদালীছড়া হচ্ছে জেলা শহরের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। বর্ষিজুরা পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা কোদালীছড়াটি প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাইল হাওরে গিয়ে মিশেছে। এর মধ্যে প্রায় চার কিলোমিটার পড়েছে শহরের অংশে। কোদালীছড়ার ভাটির দিকে (শহরের বাইরে) শুকনা মৌসুমে বোরো চাষে সেচের জন্য বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেওয়া হয়ে থাকে। এই বাঁধ পরে অপসারণ করা হয় না।

অনেকে মাছ ধরতে কোদালীছড়ার নানা স্থানে ফাঁদ পেতে থাকেন। এসব কারণে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া কোদালীছড়ার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের আজমেরুতে একটি জলকপাট (স্লুইসগেট) আছে। এই জলকপাটের মধ্যে কচুরিপানাসহ নানা রকম বর্জ্য আটকে পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।
পূর্ব গির্জাপাড়া এলাকার বাসিন্দা, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক মহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাসার গ্যারেজে হাঁটুপানি ছিল। গির্জাপাড়ার সড়কসহ নিচু এলাকায় হাঁটুপানি, কোমরপানি হয়েছে। সড়কের কিছু স্থানে এখনো (আজ রোববার সকালে) পানি আছে। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সে পরিমাণ পানিনিষ্কাশনের মতো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া আগে ফাটাবিল অনেক পানি ধারণ করতে পারত। এখন আবাসনের কারণে ভরাট হয়ে গেছে। মাটি ভরাট করে বাসাবাড়ি করা হয়েছে। কোদালীছড়া খনন করলে হয়তো পানিনিষ্কাশন আরও বাড়তে পারে।’

আজ সকালে মৌলভীবাজার শহরের পূর্ব গির্জাপাড়া, টিবি হাসপাতাল সড়ক, কোদালীছড়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পূর্ব গির্জাপাড়ার কিছু এলাকায় এখনো পানি রয়েছে। কিছু বাসার ভেতরেও পানি আছে। কোদালীছড়ার টিবি হাসপাতাল সড়কসংলগ্ন স্থানের ওয়াকওয়ে তলিয়ে আছে। নিচু বাসাগুলোয় পানি। টিবি হাসপাতাল সড়কের সেতুর কাছে একজন জাল দিয়ে মাছ ধরছেন।

শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুর রহমান আজ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গতকাল সকাল ৯টা থেকে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত মৌলভীবাজারে ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি জানান, আরও দুই–তিন দিন মৌলভীবাজার অঞ্চলে এ রকম বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।

মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও মৌলভীবাজার পৌরসভার প্রশাসক বুলবুল আহমেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক বৃষ্টি হয়েছে। রাতে আমি মাঠে ছিলাম। পানি কমছে। একটা টিম কাজ করছে। আরও একটি টিম কাজে যাচ্ছে। যেখানে ব্লক আছে, সেখানেই তা অপসারণ করতে বলা হয়েছে। আমরা কাজ করছি, আশা করছি সুফল পাব।’