মেঘনায় নোঙর করা জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লঞ্চ এমভি মহারাজ-৭। গতকাল রোববার সকালে
মেঘনায় নোঙর করা জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লঞ্চ এমভি মহারাজ-৭। গতকাল রোববার সকালে

দক্ষিণের নৌপথ কতটা ঝুঁকিতে, কেন ঘটছে দুর্ঘটনা

শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশা, ডুবোচর ও নাব্যতা–সংকটে ঝুঁকিতে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ। এসব বিপজ্জনক নৌপথেই প্রতিদিন যাত্রী ও পণ্যবাহী হাজারো নৌযান চলাচল করছে। শীতে দক্ষিণাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের মধ্যে ২২টিতে পানির গভীরতা কমে গেছে। তার ওপর দীর্ঘ এই নৌপথের অনেক স্থানে নেই সংকেতবাতি, ভাসমান বয়া ও মার্কার। ফলে তীব্র কুয়াশায় রাতের বেলা ঝুঁকি নিয়ে নৌযান চালাতে হচ্ছে চালকদের। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে, ঘটছে প্রাণহানি।

চলতি শীত মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা–চাঁদপুর–বরিশাল–ভোলা নৌপথে ঘন কুয়াশায় মেঘনা নদীতে একাধিক লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত দুইটার দিকে চাঁদপুরের হাইমচরবর্তী নীলকমল বাংলাবাজার এলাকার মেঘনা নদীতে ঢাকাগামী এমভি জাকির সম্রাট–৩ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চের সঙ্গে ঝালকাঠিগামী অ্যাডভেঞ্চার–৯ নামে অপর একটি লঞ্চের সংঘর্ষ হয়। এতে ৪ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হন।

একই রাতে রাজধানীর সদরঘাট থেকে ‘ইমাম হাসান–৫’ নামের একটি লঞ্চ প্রায় ৫০০ যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে লঞ্চটি মেঘনা নদীর মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর এলাকায় পৌঁছালে নোঙর করা একটি বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগে। সংঘর্ষের সময় বিকট শব্দে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

কয়েক দিন আগে একই নৌপথে কুয়াশার কারণে বরিশালগামী এম খান–৭ নামে একটি লঞ্চের সঙ্গে ঈগল–৪ নামে অপর একটি লঞ্চের সংঘর্ষ হলে দুটি লঞ্চই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এ ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

কুয়াশার কারণে দক্ষিণের নদীপথে সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। ওই দিন ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান–১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ঘন কুয়াশায় লঞ্চটি তীরে ভেড়াতে না পেরে মাঝনদীতে চালকবিহীন ভাসছিল। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪৭ জনের মৃত্যু হয় ও অন্তত ৩১ জন নিখোঁজ হন।

লঞ্চযাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেন, রাত্রিকালীন জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে নদীর অববাহিকা, বাঁক, ডুবোচর ও চর এলাকায় বয়া, সংকেতবাতি ও মার্কার থাকার কথা। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। নিয়মিত সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ থাকলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ ও পণ্যবাহী জাহাজচালকেরা বলছেন, শীত মৌসুমে নাব্যতা–সংকটের পাশাপাশি গভীর কুয়াশা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। রাতে ডুবন্ত বাল্কহেডের কারণে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কুয়াশার মধ্যে ভাসমান বয়া, বিকন বাতি ও মার্কারের অভাব চালকদের বিপাকে ফেলছে। এতে নৌযান চরে আটকা পড়ছে, ঘটছে দুর্ঘটনা।

লঞ্চের মাস্টার–চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা থেকে বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, আমতলী, মেহেন্দীগঞ্জ, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, বাউফল, ভান্ডারিয়া, হিজলাসহ বিভিন্ন নৌপথে অনেক স্থানে ডুবোচর ও নাব্যতা–সংকট রয়েছে, যা শীতে আরও তীব্র হয়। অনেক স্থানে বয়া থাকলেও তাতে সংকেতবাতি জ্বলে না।

চলতি বছরের ১ নভেম্বর রাতে ২০০ যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা বোগদাদিয়া–৭ লঞ্চ মেঘনা নদীর একটি ডুবোচরে আটকা পড়ে। এর আগে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মগড় এলাকায় সুগন্ধা নদীতে এমভি অথৈ–১ লঞ্চ এক সপ্তাহ ধরে ডুবোচরে আটকে ছিল।

চাঁদপুর ও বরিশাল বিভাগকে প্রয়োজনীয় স্থানে বয়া, মার্কার ও সংকেতবাতি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করছি
মো. আবদুস সালাম, অতিরিক্ত পরিচালক, বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ

ঢাকা–বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি মানামী লঞ্চের পরিদর্শক বেলাল হোসেন বলেন, শীত মৌসুমে পানি কমে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এবার শীত শুরুর আগেই পানি কমে গেছে। আগে নভেম্বর মাসে লঞ্চ ডুবোচরে আটকাত, এবার অক্টোবরেই আটকাতে শুরু করে। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ।

বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী নবনীতা বিশ্বাস বলেন, ‘হিজলা এলাকার নাব্যতা–সংকট নিরসনে কাজ চলছে। নদীর বিষয়ে হাইড্রোলজি বিভাগের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

বরিশাল–ঢাকাগামী সুন্দরবন–১৬ লঞ্চের মাস্টার রুহুল আমিন বলেন, ‘নৌপথের অনেক জায়গায় সংকেতবাতি ও মার্কার না থাকায় কুয়াশার সময় লঞ্চ চালানো খুবই কঠিন। আবার অনেক স্থানে এগুলো থাকলেও তা অকেজো। আবার রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।’

লঞ্চের মাস্টাররা জানান, ঢাকা-আমতলী, পটুয়াখালী, গলাচিপা, খেপুপাড়া, রাঙ্গাবালী নৌপথে ভোলার ইলিশার জনতা বাজার, সাদেকপুর পল্টন এলাকা, ডান পাশের টেক, মাঝকাজীপাড়, ভেদরিয়ার শ্রীপুরের টেক এবং পাড়ে কোনো সংকেতবাতি না থাকায় এই নৌপথও ঝুঁকি নিয়ে নৌযান চলাচল করতে হচ্ছে। একইভাবে মেহেন্দীগঞ্জের শ্রীপুরের চরেও সংকেতবাতি নেই। এ ছাড়া মেহেন্দীগঞ্জের শ্রীপুর থেকে দুর্গাপাশা পর্যন্ত বয়া থাকলেও সংকেতবাতি নেই।

ঢাকা–বরগুনা নৌপথেও বিভিন্ন স্থানে মার্কার ও সংকেতবাতির অভাব রয়েছে। ঝালকাঠি থেকে বরগুনা নৌপথের চল্লিশ কাউনিয়ার বাঁ পাড়ের চরের মাথায় মার্কার, সিগন্যাল বাতি নেই। হদুয়ার ডান পাড়ের চরে, নেয়ামতি ঘাটের ডানে-বাঁয়ে, নেয়ামতি থেকে বেতাগী পর্যন্ত কোনো মার্কার, সংকেতবাতি নেই। ফলে এই পথে লঞ্চচালকদের ঝুঁকি নিয়ে নৌযান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

ঢাকা–বরগুনা নৌপথের এমভি পূবালী–১ লঞ্চের মাস্টার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেলের পর থেকে বরগুনা পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার নৌপথে কোনো মার্কার ও সংকেতবাতি নেই। তাই রাতে সতর্ক হয়ে লঞ্চ চালাতে হয়।’

বরিশাল-ঢাকাগামী লঞ্চের একাধিক মাস্টার জানান, ঢাকা-বরিশাল পথের অধিকাংশ লঞ্চ নতুন প্রজন্মের হওয়ায় এসব লঞ্চে রাডার, ইকোসাউন্ডারসহ আধুনিক দিকনির্ণয় যন্ত্র থাকায় এত দিন ঝুঁকি কম ছিল। তবে এখন কুয়াশার স্তর এত গাঢ় যে সামনে এক-দেড় ফুটের মধ্যেও কিছু দেখা যায় না। আর বরিশাল-ঢাকা নৌপথের বাইরে অন্যান্য পথে চলাচলকারী কোনো লঞ্চের অপারেটিং ও ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিক নয়।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (নৌপথ) মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘চাঁদপুর ও বরিশাল বিভাগকে প্রয়োজনীয় স্থানে বয়া, মার্কার ও সংকেতবাতি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করছি।’