
সোহেল মারা গেছেন, চার বছরের শিশুসন্তান আবদুল্লাহ সেটি বুঝতে চায় না। ‘বাবা কখন আসবে’, ‘বাবা কোথায় গেছে’, ‘বাবা কেন এখনো আসে না’—দিনমান মাকে এমন হাজারো প্রশ্ন তার, আর বাবাকে এনে দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি। সোহেলের স্ত্রী মিতু আক্তার (২৩) বলেন, ‘বাবার জন্য যখন ছেলে কাঁদে, তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, গ্রামের বাড়িতে গেছে, চলে আসবে। আবার কখনো বলি, বাইরে কাজে গেছে। মিথ্যা কথা বলে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন বাবা আসে না, তখন খুব কাঁদে ছেলে।’
মিতু আক্তার আরও বলেন, ‘৪ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে যখন বাসা থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়ে যায়, তখন না করেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। স্বামীকে যখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আমরা যে এলাকায় থাকি, সেখানকার একজন রামপুরা এলাকায় লাশ দেখে এসে আমাদের খবর দেয়। আমার স্বামীর লাশ ময়লার গাড়িতে তুলে ফেলা হচ্ছিল। সেখান থেকে নামিয়ে রাখা হয়। বুকের বাঁ দিকে আর হাতে তিনটা গুলি লেগেছিল।’ তিনি একপর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলেন, ‘অবুঝ সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা...।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সোহেল মিয়ার (২৭) বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গোয়াতলা ইউনিয়নের জোকা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল হাকিম (৬৭) ও মায়ের নাম আমিনা খাতুন (৫৮)। মা–বাবা দুজনই বেঁচে আছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে পঞ্চম সোহেল। স্ত্রী মিতু ও একমাত্র সন্তান আবদুল্লাহকে নিয়ে রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন সোহেল। সেখানকার একটি খাবারের হোটেলে কখনো শ্রমিকের কাজ, আবার কখনো রিকশা চালাতেন। সোহেল মারা যাওয়ার পর শিশুসন্তানকে নিয়ে শাহজাদপুর এলাকায় মা–বাবার কাছে থাকছেন মিতু।
সোহেলের মা–বাবা থাকেন রাজধানীর ভাটারা থানার বসুমতি এলাকায়। বাবা আবদুল হাকিম একসময় দিনমজুরের কাজ করলেও অসুস্থ হওয়ায় এখন কাজে যেতে না পারেন না। মা আমিনা খাতুন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। এর সঙ্গে সোহেলের দেওয়া কিছু টাকা মিলিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার জীবন চলছিল। সোহেল মারা যাওয়ায় তাঁরাও পড়েছেন অথই সাগরে।
স্বজনেরা জানান, ৪ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে মিছিলে যাওয়া জন্য বাসা থেকে বের হন সোহেল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শ্বশুর স্বপন মিয়ার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তাঁর। সে সময় রামপুর এলাকায় নিজের অবস্থান জানিয়েছিলেন সোহেল। দ্রুত বাসায় ফিরবেন, সে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু সেই রাতে আর বাসায় ফেরেননি তিনি। তাঁর মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। ৫ আগস্ট সারা দিনেও খোঁজ পাওয়া যায়নি সোহেলের। ৬ আগস্ট সকালে রামপুরার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের কাছে খোঁজ মেলে তাঁর। সোহেল যে এলাকায় ভাড়া থাকেন, সেখানকার একজন পরিচিত ব্যক্তি রামপুরা এলাকায় গিয়ে ময়লার গাড়িতে সোহেলের লাশ তুলতে দেখে লাশটি নামিয়ে রাখেন। খবর দেন তাঁর পরিবারকে। পরে সেখানে স্বজনেরা গিয়ে গুলিবিদ্ধ সোহেলের মরদেহ নিয়ে আসেন।
সোহেলের মরদেহ সেদিনই ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেদিন রাত ৯টার দিকে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাশ পাওয়ার পর স্বজনেরা দেখতে পান, তাঁর বুকে একটি ও হাতে দুটি গুলি লেগেছিল। এর মধ্যে হাতের একটি গুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। দুটি গুলি আটকে ছিল শরীরে।
সোহেলের মা আমিনা খাতুন বলেন, ‘গৃহকর্মীর কাজ করে সাত হাজার টাকা পাই। ৩ হাজার ২০০ টাকা রুম ভাড়া দিয়ে বাকি টাকায় জীবন চলছে। ছেলে জীবিত থাকার সময় প্রতি মাসে আমাদের সহযোগিতা করত। এখন সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে গিয়ে যে থাকব, সে অবস্থাও নেই। বাড়িতে ঘর না থাকায় অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আল্লায় আমারে তিনডা পোলা দিছিন। জায়গা সম্পদ নাই। ঘরে পড়লে পোলারা যদি দুই লংকা কইর্যা ভাত দেয়, তেও আমরা জামাই-বউয়ের দিন যাইবো। আল্লাহ কইছে, পোলারার কামাই খাইতে পারবি না, হের লাইগ্যাই আমার পোলারে নিয়া গেছে।’
আমিনা খাতুন বলেন, ‘আন্দোলনে বহু মায়ের বুক খালি অইছে। আমার পোলার হত্যারও বিচার চাই। কিন্তু মামলা করতে যাই না। কারণ, মামলা করতে গেলেও টাকা লাগবো। কিন্তু আমাদের তো সেই সামর্থ্য নাই।’
সোহেলের বড় ভাই রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমরা খুবই গরিব। বাড়িতে ছোট একটা ভিটে ছাড়া কিছুই নেই। অন্তত আট বছর ধরে শাহজাদপুর এলাকায় থেকে হোটেলে কাজ করত সোহেল, কখনো আবার রিকশাও চালাত। মা–বাবাকে সেই দেখাশোনা করত। কিন্তু আন্দোলনে গিয়ে গুলি খেয়ে আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। আমরা যে বিচার চাইব, সে অবস্থাও আমাদের নেই।’