শর্ষে খেতে হলুদের ঢেউ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত পাহারভাঙ্গা গ্রামে। শুক্রবার সকালে তোলা
শর্ষে খেতে হলুদের ঢেউ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত পাহারভাঙ্গা গ্রামে। শুক্রবার সকালে তোলা

মাঠে মাঠে হলুদের ঢেউ

দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে হলুদের ঢেউ। শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকিয়ে উঠেছে চারপাশ। তা ঘিরে মৌমাছি ও বাহারি রঙের সব প্রজাপতির ছোটাছুটি। দেখে যে কারও চোখ জুড়ায়। ঠাকুরগাঁওয়ের মাঠে মাঠে শর্ষে আবাদের এখন এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। দাম ভালো পাওয়ায় জেলায় প্রতিবছর বাড়ছে শর্ষের আবাদ। গত পাঁচ বছরে ঠাকুরগাঁওয়ে সাত হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে শর্ষের আবাদ বেড়েছে।

কৃষি বিভাগ বলছে, আমন ধান ঘরে তোলার পর বোরো চাষের আগে জমি পতিত পড়ে থাকত। এ সময়ে অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় কৃষকেরা শর্ষে চাষ করেন। এ জন্য কৃষকদের অনেকে শর্ষেকে ‘ফাউ ফসল’ বলেও অভিহিত করেন। শর্ষে চাষে কৃষকেরা যে সার ব্যবহার করেন, সেটির উপকারিতা জমিতে দীর্ঘদিন ধরে থাকে। এতে শর্ষের জমিতে কম সার দিয়ে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়। এ কারণে কৃষকেরা শর্ষে আবাদের দিকে ঝুঁকছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে জেলায় শর্ষে চাষ বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জেলায় ১২ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে শর্ষে আবাদ হয়েছিল। শর্ষে উৎপাদন হয়েছিল ১৯ হাজার ৬৯৮ মেট্রিক টন। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩৭৪ হেক্টর। শর্ষে উৎপাদিত হয় ২১ হাজার ১৭২ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৯২৩ হেক্টর জমিতে ২৪ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে ৩০ হাজার ৬৭৪ মেট্রিক টন শর্ষে উৎপাদিত হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।

শর্ষেখেত দেখভাল করছেন এক কৃষক। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার ভোলাপাড়ায়

গত শনি, রবি ও মঙ্গলবার রানীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী ও সদর উপজেলার তিনটি হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে চাষিরা প্রতি মণ শর্ষে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়।

সদর উপজেলার ভানোর গ্রামের কৃষক হোসেন উদ্দিন আড়াই বিঘা (৫০ শতকে বিঘা) জমিতে শর্ষে আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, আমন ও বোরো চাষের মাঝের সময়ে আবাদ করায় শর্ষে চাষে সামান্য ইউরিয়া ছাড়া কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। বীজ বোনার ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। চারা গজানোর পর আগাছা পরিষ্কার করা ছাড়া তেমন কোনো শ্রমেরও দরকার হয় না। আবার খেতের চারা শাক হিসেবেও বিক্রি করা যায়।

একই গ্রামের কৃষক সুভাষ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমন ধান কাটার পর হামরা জমিত বোরো ধান লাগাইছিনু। মাঝের সময়টা জমি খালি পড়ি আছিল। অ্যালা ওই জমিত সোরিসা লাগাইছু। আমন আর বোরোর ফাঁকোতে সোরিসা হয়ে যাছে।’

দিগন্তবিস্তৃত শর্ষের মাঠে হলুদের ঢেউ। ঠাকুরগাঁওয়ের মাঠে মাঠে শর্ষে আবাদের এখন এমন দৃশ্য চোখে পড়ে

গত বছর ৩ বিঘা জমিতে বারি-১৪ জাতের শর্ষে চাষ করেছিলেন রানীশংকৈল উপজেলার ভোলাপাড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা। বিঘাপ্রতি তাঁর খরচ হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার টাকা। ফলন পেয়েছিলেন ১৮ মণ। গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ভালো লাভ হওয়ায় এবার ৬ বিঘা জমিতে শর্ষে চাষ করেছি। আশা করছি, এবারও ভালো ফলন ও দাম পাব।’

পাশের বলিদ্বারা গ্রামের রইসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর চার বিঘা জমিতে শর্ষে চাষ করেছিলাম। এবার সাত বিঘা জমিতে করেছি। কৃষি বিভাগ থেকে এক বিঘা জমির বীজ ও সার প্রণোদনা দিয়েছে। গত বছর ফলন ভালো ছিল। দামও ভালো পেয়েছি। প্রতি মণ শর্ষ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম।’

দাম ভালো পাওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিবছর বাড়ছে শর্ষের আবাদ। গত পাঁচ বছরে সাত হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে শর্ষের আবাদ বেড়েছে

হরিপুর উপজেলার কামারপুর গ্রামের কৃষক মোবারবক আলী বলেন, প্রথমবারের মতো তিনি ২৫ শতাংশ জমিতে শর্ষে চাষ করেছেন। খরচ পড়েছে ২ হাজার ২০০ টাকা। আশা করছেন, চার মণ শর্ষে পাবেন। গত বছর গ্রামে চার থেকে পাঁচজন কৃষক শর্ষে চাষ করেছিলেন। তাঁদের দেখে এবার এলাকার ৩০ জনের বেশি শর্ষে চাষ করেছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকদের শর্ষে চাষে আগ্রহী করতে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হচ্ছে। গত বছর আশানুরূপ ফলন ও দাম পাওয়ায় কৃষকেরা উৎসাহী হয়েছেন। শর্ষে তিন মাস মেয়াদি ফসল। কম খরচ ও পরিশ্রমে শর্ষে লাভজনক ফসলে পরিণত হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকেরা দিন দিন শর্ষে চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এ জন্য প্রতিবছর শর্ষের আবাদ বাড়ছে।