
জন্মের পরপরই বাবাকে হারিয়েছেন মিলন হোসেন (৩৫)। বুঝতে শেখার পর দেখলেন দুই ভাই আলাদা সংসার পেতেছেন। মিলনের আশ্রয় তখন মায়ের আঁচল। মায়ের দিনমজুরিতে খাবার জোটে মিলনের।
মিলনের বয়স তখন ছয় কিংবা সাত। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর রাতে এসে মা রান্না করেন। এসব দেখে মিলনের আর ভালো লাগে না। মায়ের আশা, ছেলে পড়াশোনা করে বড় হবে। কিন্তু মিলনের ইচ্ছা মায়ের দুঃখ ঘোচানো। সিদ্ধান্ত নেন কাজে লেগে যাবেন। তারপর কেটে গেছে ২৮ বছর। মিলনের সত্তরোর্ধ্ব মা এখনো তাঁর সঙ্গেই আছেন।
নারায়ণগঞ্জ বন্দরে যাঁদের নিয়মিত চলাফেরা, তাঁরা মিলনকে চেনেন। অসুস্থতায় কুঁজো হয়ে যাওয়া ছোট্ট শরীর নিয়ে প্রতিদিন বিকেল হলেই তিনি ফেরিঘাট এলাকায় দোকান খুলে বসেন। গভীর রাত পর্যন্ত ডিম আর রুটি বিক্রি করেন। হেমন্তের এমনই এক রাতে মিলনের সঙ্গে কথা হয়।
স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে আর মাকে নিয়ে বন্দরের লেদারস আবাসিক এলাকায় আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় একটি বাসায় থাকেন মিলন। ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ের পাশাপাশি ৪ বছরের একটি ছেলে আছে তাঁর। মিলনের একার আয়েই চলে পাঁচজনের সংসার।
কথায় কথায় মিলন বলেন, নারায়ণগঞ্জের টানবাজার হোশিয়ারিপল্লিতে তিনি সুতাকাটার শ্রমিক ছিলেন। কাজ করতে করতে একসময় ‘ওস্তাদ’ হয়ে ওঠেন। হোশিয়ারির কাজে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের মেশিন চালানোর পাশাপাশি ‘কাটিং ম্যান’ হিসেবেও হাত পাকিয়ে নেন। তত দিনে অভাব কিছুটা দূর হয়। বিয়ে করে সংসার পাতেন। জন্ম হয় প্রথম সন্তানের।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মিলন যখন নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর, তখনই তাঁর দুঃসময় আসে। হঠাৎ টাইফয়েড জ্বরে পড়েন মিলন। ধারদেনা করে স্থানীয় এক চিকিৎসক দেখান। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও ধীরে ধীরে চলাফেরার ক্ষমতা হারাতে থাকেন তিনি। সেসব দিনের কথা মনে করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
মিলন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা তিন মাস ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি ছিলাম। সেখানকার ডাক্তার বলছিলেন, ভুল চিকিৎসায় আমি আজীবনের লাইগা পঙ্গু হইয়া গেছি। পরে আমার মেরুদণ্ড বাঁকা হইয়া গেল। আমি এখন আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না।’
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মিলনের নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। পুরোনো কর্মস্থলে গিয়ে দেখেন, কোনো কাজই করতে পারছেন না। তখন থেকেই ডিম-রুটি বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকার ডিম-রুটি নিয়ে বসেন। খরচ বাদে দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। ওই আয়েই অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, মেয়ের পড়াশোনা আর পাঁচটি মুখে খাবার জোটে।
তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে মিলনকে। করোনার কারণে দেনায় পড়েছিলেন। সেই দেনার পাঁচ হাজার টাকা এখনো শোধ হয়নি। এর মধ্যে বাড়তি বাজারদরে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইচ্ছা সত্ত্বেও পুঁজি বাড়াতে পারছেন না। আশায় বুক বেঁধেছেন, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে’ প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার টাকার পণ্য নিয়ে বসবেন। তাতে আয়ও বেশি হবে। বাড়তি আয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা হবে।
কথার ফাঁকে মিলনের কাছে জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কি না জানতে চাইলে হেসে ফেলেন তিনি। কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলেন বলেন, ‘কিছু লোক আছে খাইয়া টাকা না দিয়া চইলা যায়। তারা হয়তো ভাবে আমি প্রতিবন্ধী, চাইলেও কিছু করতে পারমু না। এসব মানুষ নিয়া দুঃখ হয়। এমনিতে আমার জীবনে দুঃখ ছাড়া কিছু পাই নাই, ছোডবেলা থেইকা কাম কইরাই জীবন শেষ। কোনো দিনও উচ্ছ্বাস করতে পারি নাই। একটা সুস্থ মানুষ ভুল চিকিৎসায় প্রতিবন্ধী হইয়া গেলাম।’
মিলন বলেন, ‘প্রথম প্রথম এসব ভাইবা খুব কষ্ট লাগত। পরে ভাইবা দেখলাম, জীবন আসলে এমনই, কোনো মানুষের জীবনই পরিপূর্ণ হয় না। কারও অর্থসম্পদ নাই, কারও মনের মানুষ নাই, কারও আবার চরিত্রই নাই। আমার মতো কারও কারও স্বাস্থ্য নাই। আবার দেখি সবই আছে, কিন্তু সুখ নাই। এটা দুনিয়ার নিয়ম। আমি এই নিয়ম মাইনা নিছি। এখন একটাই চাওয়া, জীবনে যেন সম্মান নিয়া বাঁচতে পারি। কারও কাছে যেন মাথা নত করতে না হয়।’