
টানা ভারী বৃষ্টিতে খুলনা শহরের বেশির ভাগ সড়ক ও নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। এমন পরিস্থিতিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের নেওয়া প্রায় ৮২৪ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গতকাল সোমবার বিকেল চারটা থেকে খুলনায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৮২ মিলিমিটার। আগামীকাল বুধবার থেকে বৃষ্টিপাত কিছুটা কমতে পারে।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের নতুন রাস্তা মোড়, আবু নাসের হাসপাতাল এলাকা, মুজগুন্নি সড়কের বয়রা পুলিশ লাইন, আহসান আহমেদ রোড, খানজাহান আলী সড়কের রয়েল মোড়, কেএমপি সদর দপ্তর, দোলখোলা মোড়, নতুন বাজার, লবণচরা, টুটপাড়া এলাকার সড়কে হাঁটুপানি। যেসব সড়কে উন্নয়নকাজ চলছে, সেখানে ভোগান্তি আরও বেড়েছে।
টানা বৃষ্টিতে গতকাল সন্ধ্যা থেকেই নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কর্মজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। আজ সকালে অফিসগামী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি।
সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় হাঁটুপানি। রিকশা ভাড়া বেশি দিয়ে আসতে হয়েছে। তারপরও অনেকটা ভিজে গেছি।’ রিকশাচালক জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে লোকজন তেমন বের হতে পারছে না। সকাল থেকে মাত্র দুই-তিনটা ভাড়া হয়েছে। এত কম আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।’
বয়রা পুলিশ লাইনের সামনের চায়ের দোকানদার নূর ইসলাম বলেন, বৃষ্টি হলেই এখানে পানিতে ডুবে যায়। গতকাল বিকেল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি হয়েছে। আশপাশের সব এলাকার রাস্তাগুলো পানিতে ডুবে আছে। বেচাকেনা একদমই হচ্ছে না।
নগরবাসীর অভিযোগ, পানি নিষ্কাশনের মূল মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ২২টি খাল এখনো দখলমুক্ত বা সংস্কার হয়নি। নালা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। অনেক জায়গায় রাস্তার চেয়ে নালা উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। জলাধার ভরাট হওয়ায় দ্রুত জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
খুলনা নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, ভৈরব ও রূপসা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নদীতে নামতে পারছে না। উল্টো জোয়ারের সময় পানি শহরের দিকে ঠেলে আসছে। বিল পাবলা ও রায়ের মহলের মতো বড় জলাধার ভরাট হওয়ায় পানি জমার কোনো জায়গা নেই।
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা গেছে, ‘খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেকে অনুমোদন পায়। ৮২৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় গত সাত বছরে ১৯৮টি নালা পুনর্নির্মাণ ও ময়ূর নদীসহ ১০টি খাল খনন করেছে সিটি করপোরেশন। ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পে প্রায় ৬৩৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের সব কাজ শেষ না হওয়া ও পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজজামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নাগরিকেরা আপাতত জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না। গত চার দশকে সব মেয়রই এ সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ২২টি খাল এখনো দখলমুক্ত হয়নি। পানি নিষ্কাশনের ছোট ছোট পথগুলোও বন্ধ। তার ওপর সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে চলেছে। অনেক জায়গায় রাস্তার চেয়ে নালা উঁচু। আর যেসব বক্স ড্রেন তৈরি হয়েছে, সেগুলোর ভেতরে পানি ঢোকার ছোট ছোট পাইপের মুখ বন্ধ। রাস্তার সঙ্গে নালার সংযোগ নেই। আসলে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কোনো প্রকল্প কাজে আসে না।’
জানতে চাইলে কেসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কোহিনুর জাহান বলেন, খুলনা শহরটা নিচু। জোয়ারের সময় পানি ঢোকে। আবার যেসব জায়গা দিয়ে পানি সরার কথা সেখানে পূর্ত বিভাগের কাজ চলছে। রাস্তার কাজের জন্য যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর কিছু কিছু তাঁরা কেটে দিয়েছেন, যাতে পানি সরতে পারে। বৃষ্টির মধ্যে পূর্ত বিভাগের কাজ না করার বিষয়টি প্রশাসককে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নালার উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পাম্প স্টেশন ও স্লুইসগেট সংস্কারের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে জলজট অনেকটা কমে যাবে।