সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজারে নজরুল ইসলামের পানের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজারে নজরুল ইসলামের পানের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়

পানের দোকানেই নজরুলের সাফল্য, জমি কিনে করেছেন দোতলা বাড়ি

বাজারে ঢুকলেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি দোকান। নাম নজরুল ইসলাম অ্যান্ড সন্স পান বিতান। আরও এটিকে সহজে চেনা যায় ক্রেতাদের ভিড় দেখে। প্রায় দিনই সকাল থেকে রাত অবধি সেখানে ভিড় লেগেই থাকে।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজারে ওই পানের দোকানের অবস্থান। দোকানটির পাশে দাঁড়ালেই ভেসে আসে পানপাতার সুবাস। চুন-সুপারির আর নানান মসলার মিষ্টি গন্ধ, যা সহজেই ক্রেতাদের মোহিত করে। সেখান থেকে খিলি প্রতি ৮-১০ টাকায় পান কেনেন ক্রেতারা। কেউ আবার মুখে পান দিয়ে হয়ে থাকেন আড্ডায় মশগুল।

দোকানটির মালিক নজরুল ইসলাম। বয়স ৬০ পেরিয়েছে; তবু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে পান বানিয়ে ক্রেতাদের দেন। শান্ত, হাস্যোজ্জ্বল ও আত্মবিশ্বাসী চোখই যেন তাঁর পরিচয়।

অথচ চার দশক আগেও নজরুল ছিলেন ভিন্ন এক মানুষ। অষ্টম শ্রেণি পার হওয়ার আগেই অভাবের তাড়নায় বইখাতা গুটিয়ে নেমে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। একসময় অন্যের দোকানে কাজ করতেন। সেখান থেকেই শেখা, পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন নিজের পানের দোকানটি।

১৯৯০ সালে ধারদেনা করে দোকানটির কার্যক্রম শুরু করেন নজরুল। তবে শুরুর লড়াইটা এত সহজ ছিল না। ৫-৭ বছর ব্যবসা তেমন ভালো যায়নি। ধীরে ধীরে জমে ওঠে ব্যবসা। বিশেষ খিলির ভিন্ন স্বাদ আর ক্রেতাদের আস্থা হয়ে ওঠে তাঁর ব্যবসার মূলশক্তি। এখন প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানটিতে ভিড় লেগেই থাকে। বিশেষ করে সকাল থেকে দুপুর এবং বিকেল থেকে রাত অবধি ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি।

ক্রেতাদের চাপ সামলাতে নজরুলকে সহযোগিতা করেন তাঁর ছেলেরা

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নজরুল ইসলামের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, বড় ছেলে সিদ্দিককে নিয়ে পান তৈরি করছেন নজরুল। দোকানের সামনে বেশ ভিড়। লাইন দিয়ে পান কিনছেন ক্রেতারা। ডাসা-ডাসা পান আর নানা ধরনের মসলায় সাজানো দোকানটি।
ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় নজরুল ইসলামের সঙ্গে। বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। এক সময় সংসার চালানোই মুশকিল ছিল। এখন এই দোকানই আমার ভরসা। এই ব্যবসার টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পেরেছি, সংসারও ভালো চলছে।’

ক্রেতারা জানান, নজরুলের দোকানের মূল আকর্ষণ পানের খিলি। প্রতিটি খিলি তৈরি হয় ৩০ থেকে ৩৫ ধরনের মসলার মিশ্রণে। ধনে, কালিজিরা, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জায়ফল, বাদাম, ফল মিলিয়ে একেকটি খিলির অনন্য সুবাস।

নজরুল ইসলামের ভাষ্য, দিনে তিন থেকে চার হাজার খিলি বিক্রি হয়। অধিকাংশ খিলির দাম ১০ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি খিলি থেকে লাভ হয় ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা। তবে অনেক খিলি বিক্রি হওয়ায় লাভের হিসাবে তেমন সমস্যা হয় না।

নজরুলের দোকানে শুধু স্থানীয় বাসিন্দারাই নন, দূরদূরান্ত থেকেও ক্রেতারা আসেন। খুলনার চুকনগর, ডুমুরিয়া, যশোরের কেশবপুর, এমনকি সাতক্ষীরা শহর থেকেও অনেকেই তাঁর দোকানের পান খেতে ছুটে আসেন। তাঁদেরই একজন খুলনার শরিফুল ইসলাম। বন্ধুদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি হাজির হন পানের দোকানটিতে। তিনি বলেন, ‘নজরুল ভাইয়ের পানের স্বাদই আলাদা। এ জন্য মাঝেমধ্যে এখানে আসি।’

স্থানীয় বাসিন্দা ওলিউর রহমানের দাবি, ‘একবার যে নজরুল ভাইয়ের পান খেয়েছেন, সে আর অন্য পান খেতে চায় না।’

অনেক সময় ক্রেতাদের চাপে নজরুলের একার পক্ষে দোকান সামলানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়। দুই ছেলে তাঁকে সহায়তা করেন। তাঁর ছেলে সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা তিনজন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খদ্দরদের সেবা দিই। যত দ্রুত সম্ভব পান তৈরি করি, যাতে কেউ অপেক্ষায় কষ্ট না পান।’

নজরুল ইসলাম বলেন, পান বিক্রির টাকায় শুধু সংসারই চালাননি, বদলেছেন নিজের ভবিষ্যৎ। পাটকেলঘাটার বাণিজ্যিক এলাকায় কিনেছেন আট শতাংশ জমি। সেই জমিতেই এখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর আট কক্ষবিশিষ্ট দোতলা বাড়ি।

নজরুলকে একজন সফল ব্যবসায়ী উল্লেখ করেন পাটকেলঘাটা বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ছোট্ট একটি পানের দোকান যে একটি পরিবারের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারে, নজরুল ইসলাম এর জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর গল্প এখন অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে যাঁরা ছোট থেকে শুরু করে বড় (ব্যবসায়ী) হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।