
ঝিকঝিক শব্দ তুলে দিগন্তে মিলিয়ে গেল ট্রেন। তখনই কানে ভেসে এল ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’ উৎস খুঁজতেই দেখা গেল, রেললাইনের পাশেই প্রাচীরঘেরা বিদ্যালয়ের মাঠে একদল শিক্ষার্থী বাদ্যের তালে তালে গান গাইছে। আরেক দল গানের তালে নেচে চলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন একজন শিক্ষক।
এই শিক্ষকের নাম মো. আবদুল মাজেদ। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার সেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আগ্রহের বশে ইউটিউবে ভিডিও দেখে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংগীতচর্চা, নাচ, অভিনয়, কুইজ, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, ছবি আঁকাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে মাজেদের এই ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ বদলে দিয়েছে বিদ্যালয়টিকে। একসময় শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। এখন উপস্থিতি শতভাগ বললেই চলে। ঝরে পড়ার হারও শূন্যের ঘরে। পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহও বেড়েছে ঢের, যার প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার ফলে। নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও নিয়ে আসছে শতবর্ষী এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে মো. আবদুল মাজেদের বাড়ি। ২০০৬ সালে তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর স্ত্রীও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
ইউকুলেলে দিয়ে শুরু
বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে আবদুল মাজেদ শিক্ষার্থীদের গণিত শেখাতেন। একদিন তাঁর মনে হলো, বিদ্যালয়ে শেখার মধ্যে আনন্দ নেই। শিক্ষাকে আনন্দময় করার পথ খুঁজতে লাগলেন তিনি। ২০১৫ সালে ইউটিউব ঘেঁটে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা শুরু করলেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষককে প্রস্তাব দেন, ক্লাসের বিরতিতে শিক্ষার্থীদের সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র শেখাতে চান। সায় পেয়ে নিজের ৫ হাজার ৮০০ টাকায় একটি ইউকুলেলে (হাওয়াইয়ান বাদ্যযন্ত্র) কেনেন। তা দিয়েই শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলতে লাগল সংগীত শেখানোর কাজ।
শুরুতেই আবদুল মাজেদ দেখলেন, যেদিন সংগীতের ক্লাস চলে, সেদিন প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। এতে তিনি উৎসাহ পান, যা নজরে আসে প্রধান শিক্ষকেরও। তিনি বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (স্লিপ) তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন, যা দিয়ে কাহন, হাতবয়া, জিপসি ও গিটারের মতো বাদ্যযন্ত্র কেনা হয়। গান শেখানোর পাশাপাশি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অন্য সহশিক্ষা কার্যক্রমও।
‘স্যার আমাদের ভয় দূর করেছেন’
বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, সাজানো-গোছানো বিদ্যালয়ের মাঠে সৌরভ শর্মা, সাদ আল মুনতাসীর, নুর হোসেনেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে। গানের তালে তালে মিষ্টি, শাম্মিরা নাচছে। আবদুল মাজেদ হাতবয়া বাজিয়ে তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে গান থামিয়ে তালিম দিচ্ছেন। একদল শিক্ষার্থী মাঠে বসে তা উপভোগ করছে।
কাহনে তাল তুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সৌরভ শর্মা গাইছিল ‘শালুক ফুলের লাজ নাই/ রাইতে শালুক ফোটে লো...।’ গান শেষ হলে সৌরভ বলে, ‘আমি যখন থ্রিতে পড়ি, তখন থেকে গান শিখছি। এখন আমি অনেকগুলো গান গাইতে পারি। ইউকুলেলে, কাহন ও গিটার বাজাতে পারি। স্কুলের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চর্চা করি। এখন স্কুলে না এলে কেমন জানি লাগে।’
পাশে দাঁড়িয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বাপ্পি হাসান ইউকুলেলেতে টুংটাং তাল তুলছিল। তাকে একটি গান গাইতে বলতেই সে শুরু করে দিল, ‘এমন যদি হতো/আমি পাখির মতো...।’ গান শেষে হাসান বলে, ‘আগে স্কুলে নতুন কেউ এলে ভয় ভয় লাগত। এখন সেই ভয় আর নাই। স্যার (আবদুল মাজেদ) আমাদের সব ভয় দূর করে দিয়েছেন।’
এ বছর বিদ্যালয় ছেড়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে লিমা রানী শর্মা, প্রিয়া রানী শর্মা, ঋতিক চন্দ্র শীলরা। লিমা রানী বলল, ‘স্কুল ছেড়ে এলেও মন পড়ে আছে সেখানে। মাঝেমধ্যে এখন সেখানে চলে যাই। নতুন নতুন গান গাই, নাচ করি।’
জেলা–উপজেলায় সেরা শিক্ষার্থীরা
আবদুল মাজেদ শুধু শিক্ষার্থীদের নৃত্য, সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র শেখানোতেই থেমে থাকেননি। তাঁদের নিয়ে নিয়মিত কুইজ ও উপস্থিত বক্তৃতা, ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। বিজয়ীদের জন্য থাকে স্কুলের পোশাক, খাতা-কলমসহ শিক্ষা উপকরণ। উপকরণের অভাবে যেন শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ না হয়, সে জন্যই এই কৌশল।
২০২৩ সালে ইউনিয়ন পর্যায়ে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতায় ১৫টি ইভেন্টে প্রথম, ১৪টি ইভেন্টে দ্বিতীয় ও ছয়টি ইভেন্টে তৃতীয় স্থান দখল করে সেনুয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেবার উপজেলা পর্যায়ে ৯টি এবং জেলা পর্যায়ে সংগীত, উপস্থিত বক্তৃতা ও একক অভিনয় পুরস্কার লাভ করে শিক্ষার্থীরা। গত বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে নানা ইভেন্টে ৩৬টি পুরস্কার পায় মাজেদের শিক্ষার্থীরা। তার মধ্যে ১৯টিই প্রথম পুরস্কার। উপজেলা পর্যায়ে তিনটিতে প্রথমসহ মোট আটটি পুরস্কার অর্জন করে শিক্ষার্থীরা। জেলা পর্যায়ে এসে তারা একক অভিনয় ও উপস্থিত বক্তৃতায় তিনটি পুরস্কার লাভ করে।
শুধু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নয়, বিদ্যালয়ের ফলেও প্রভাব ফেলেছে মাজেদের এই পদক্ষেপ। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাফফর আলী বলেন, এখন সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়। বিদ্যালয় থেকে স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের দিকে একজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছিল। সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরালো হওয়ার পর প্রতিবছরই একজন–দুজন করে বৃত্তি পাচ্ছে। সবশেষ ২০২২ সালে একজন ট্যালেন্টপুলে ও একজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়। বৃত্তি পাওয়াদের একজন রিমা আকতার ভালো আবৃত্তি করত। উপস্থিত বক্তৃতায় ইউনিয়নে সেরা ছিল।
আবদুল মাজেদ বলেন, ‘প্রত্যন্ত এ এলাকার শিশুরা বিদ্যালয়কে ভয়ের জায়গা মনে করত। তাই বিদ্যালয়ে আসতে তাদের অনীহা ছিল। আমি সেই ভয়টা দূর করে বিদ্যালয়কে আনন্দের জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছি। সে কারণে আমি ইউটিউব দেখে দেখে নিজে শিখি, এরপর ছাত্রছাত্রীদেরও শেখাই।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন
১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২৯। শিক্ষক আটজন। সহকারী শিক্ষক মামুনি আক্তার বলেন, ‘একটা সময় বিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীও আসত না। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছি। এখন শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই বিদ্যালয়ে আসে। এতে আমাদের পরিশ্রমও কমে গেছে।’
আবদুল মাজেদের এই উদ্যোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক শাহ মো. জুলিয়াস জামান বলেন, মাজেদের উদ্যোগে উপস্থিতির হার বেড়েছে। ঝরে পড়া এখন শূন্যের কোঠায়। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীরা এখন আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করছে।
ফেরার পথে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে শোনা গেল ‘পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না...।’ এলাকার সাবেক শিক্ষক হাসান আলী সেই গানের সুর ধরেই বললেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে নিয়ে আসলেই হেলা করার আর সুযোগ নেই। ভয় দূর করে শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করে তুলতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হতে সহায়তা করে উল্লেখ করে ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, সব স্কুলে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে। তবে সেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ কাজটি ভালোভাবে করে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরালো হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।