সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর একসঙ্গে খেতে বসেন কৃষিশ্রমিকেরা, চলে খাবার আদান-প্রদান

দুপুরের বিরতিতে এভাবেই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন কৃষিশ্রমিকেরা। রোববার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঝাড়বাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

খেতজুড়ে পাকা গম। প্রখর রোদে কাস্তের টানে মুঠি মুঠি গমের গোছা কেটে চলছেন একদল কৃষিশ্রমিক। রোদে পোড়া শরীরে কাজ করতে করতে একসময় পেটে মোচর দেয়। শ্রমিকেরা কাজ থামিয়ে দিলেন। হাতে হাতে পোঁটলা নিয়ে গাছতলায় দল বেঁধে বসে পড়লেন। এরপর পোঁটলা খুলেই শুরু হলো খাওয়াদাওয়ার পর্ব। খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে তরকারি বিনিময় করলেন কেউ কেউ।

আজ রোববার দুপুরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঝাড়বাড়ি এলাকায় এ দৃশ্যের দেখা মিলল। গম আবাদের জন্য প্রসিদ্ধ জেলা হলো ঠাকুরগাঁও। জেলাজুড়ে এখন চলছে গম কাটা-মাড়াই মৌসুম। কৃষকেরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুপুর ১২টার দিকে ঝারবাড়ী এলাকায় দেখা যায়, পাকা সড়কের ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড়, পাড়া–মহল্লা, বাজার, স্কুল, মসজিদ, চায়ের দোকান, পুকুর—এসব রেখে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দূরদূরান্তে। সেই পথ দিয়ে যেতে চোখে পড়ে দীগন্ত ছোঁয়া ফসলি জমি। আর তা ঘিরে জনজীবনের কর্মমুখরতা।

হঠাৎ ফসলি খেতের মাঝে আটকে যায় দৃষ্টি। জনা বিশেক নারী–পুরুষ খেতের আল ধরে হেঁটে আসছেন। তাঁদের হাতে কাপড়ে বাঁধা পোঁটলা। একসময় গাছের তলে গোল হয়ে বসে পড়লেন তাঁরা। কাছে গিয়ে দেখা গেল, তাঁদের কেউ এনেছেন ভাতের সঙ্গে সবজিভাজি, কেউ এনেছেন ডিমভাজি, আবার কেউ মাছ। খেতে খেতে তাঁরা গল্প ও খুনসুটিতে মেতে উঠলেন। এর ফাঁকেই একে অন্যের সঙ্গে খাবার বিনিময় করছেন।

খেতে খেতে সুনেত্রা রানী বলেন, তাঁরা সবাই আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা। দল বেঁধে খেতে কাজ করেন। প্রতিদিন তাঁরা সামর্থ্যমতো বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসেন। কাজের ফাঁকে একসময় খেতের পাশে দল বেঁধে সবাই দুপুরের খাবার সেরে নেন।

সুনেত্রা বললেন, ‘সবাই মিলেমিশে খাবার খাও, ভালোই নাগে। যখন দেখু পাশের কারও পাতত তরকারি কম, তখন হামরা অকও কিছু তরকারি দেও।’

বলতে বলতে পাশে বসা তাপসি রানীর পাতে বাড়ি থেকে আনা মুরগির ডিমের অর্ধেক তুলে দিলেন সুনেত্রা। আর তা দেখে তাপসি বলতে লাগলেন, ‘লাগিবেনি দিদি। মোর এইখান দিয়াই খাওয়া হয়া যাবে।’ তা শুনে পাশের জয়ন্তী রানী বললেন, ‘দিদি নাও না গে। হামরা হামরাই তো।’ এ কথা শুনে তাপসি পাতের ডিমের কিছুটা অংশ জয়ন্তীর পাতে তুলে দিয়ে বললেন, তুমিও একনা খাও।

খাওয়ার ফাঁকে চলে আড্ডা আর খুনসুঁটি

আরেক পাশে বসে ভাত খাচ্ছিলেন রোশনি রায়, কাকলি রানী আর রত্না রানী। এর মধ্যে রোশনি বাড়ি থেকে এনেছেন শুঁটকি মাছের ভর্তা আর লাউ–আলুর সবজি। কাকলি পাটশাকের সঙ্গে ডাল আর রত্না এনেছেন আলু ভর্তা আর ডাল। খেতে বসার শুরুতেই রোশনি শুঁটকির ভর্তার একটা অংশ রত্নার পাতে তুলে দেন। আর রত্না আমতা আমতা করে রোশনির দেওয়া তরকারি দিয়ে তৃপ্তি করে খাওয়া সেরে ফেললেন।

এ সময় রোশনি বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়ি গেইছে। অ্যালা হামরা সবাই সব দিন বাড়ি থাকিয়া ভালো খাবার আনিবা পারু না। যায় একটু ভালো তরকারি আনু, তা ভাগ করিয়া খাও।’ বলতে বলতে আবার খাওয়া শুরু করলেন তিনি।

খাওয়া শেষে যশোদা রানী পুঁটলি খুলে বের করলেন পান-সুপারি। পান পাতার একটি অংশ ছিঁড়ে এগিয়ে দিলেন ঝিম ধরে বসে থাকা নারায়ণ বর্মনের দিকে। পানের অংশটি মুখে পুড়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আইজ পান আনুনি। শরীরখান ক্যামন যেনে করছিল। দিদি, তোমার পানখান খায়েই মুই চাঙ্গা হয়ে গেইনু।’

আখানগরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন আবদুল জব্বার। সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এই এলাকার মানুষ কৃষিজীবী। সকালে উঠেই খেতের কাজে নেমে পড়েন। কাজে যাওয়ার আগে সঙ্গে বেঁধে নেন দুপুরের খাবার। পরে একসময় তাঁরা এভাবে দল বেঁধে খান। সেখানে নানা ধর্মের মানুষ থাকে। এ সময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে খাবার বিনিময়ও করেন।

এ বিষয়ে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অরুণাংশু দত্ত বলেন, ‘একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ায় সময় কৃষিশ্রমিকদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতার চিত্রটি ফুটে ওঠে। আজকের এ সমাজে নানা বৈষম্য। এই বৈষম্যের মাঝে এমন চিত্র আমাদের আশান্বিত করে। সমাজের এ কঠিন সময়ে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার খুবই প্রয়োজন।’