
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে নওগাঁয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির ছয়জন নেতা। কোনো কোনো আসনে দলীয় প্রার্থীর বাইরে একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা নির্বাচনে থাকলে ভোটে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা। তবে একাংশের দাবি, মনোনয়নপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন।
নওগাঁয় ১১টি উপজেলা নিয়ে মোট ছয়টি সংসদীয় আসন আছে। এর মধ্যে নওগাঁ-২ ও নওগাঁ-৪ আসন ছাড়া বাকি চারটিতেই দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ছয়জন নেতা। প্রার্থী হওয়া ছয় নেতার দাবি, কর্মী-সমর্থকদের চাপে তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন।
১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয়। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত সোমবার। নির্বাচনে অংশ নিতে ছয়টি আসনে ৫৩টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ হলেও জমা পড়েছে ৪১টি। এর মধ্যে নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার) আসনে আটজন, নওগাঁ-২ (পত্নীতলা ও ধামইরহাট) আসনে ছয়জন, নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর ও বদলগাছী) আসনে আটজন, নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে সাতজন, নওগাঁ-৫ (সদর) আসনে সাতজন ও নওগাঁ-৬ (রাণীনগর ও আত্রাই) আসনে পাঁচজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নওগাঁর ছয়টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। প্রার্থী ঘোষণার পর ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করেছে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকেরা। এরপরও মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা থেমে যাননি; মনোনয়নবঞ্চিত নয়জন নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নওগাঁ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন নিয়ামতপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ছাড়া এখানে নিয়ামতপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ছালেক চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মাহমুদুস সালেহীন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ছালেক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এলাকায় কাজ করছি। মানুষের ভালোবাসায় তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছি। মানুষ এখনো আমাকে ভালোবাসে। সাধারণ ভোটারদের চাপেই মনোনয়ন জমা দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকব কি না কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
মনোনয়নবঞ্চিত নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মী-সমর্থকদের চাপেই প্রার্থী হয়েছি। তাঁরাই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে এক প্রকার জোর করে আমার স্বাক্ষর নিয়ে জমা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থী থাকা, না থাকার বিষয়টি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চাই।’
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দল, দলের নেতা-কর্মী ও তিন উপজেলার সাধারণ ভোটারদের প্রতি আমার ভরসা আছে। আমার বিশ্বাস ভোটাররা আমাকে নিরাশ করবেন না। মনোনয়নবঞ্চিত যেসব নেতা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে দল তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।’
নওগাঁ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনবারের সাবেক এমপি ও দলের কেন্দ্রীয় কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জোহা খান। এখানে মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে পত্নীতলা উপজেলা বিএনপির সদস্য খাজা নাজিবুল্লাহ চৌধুরী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেননি।
নওগাঁ-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বদলগাছী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজলে হুদা। এখানে তিনি ছাড়া বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি রবিউল আলম ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর ছেলে যুবদলের সাবেক নেতা পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী। তাঁরা দুজনেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। শেষ পর্যন্ত রবিউল আলম মনোনয়নপত্র জমা না দিলেও পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
পারভেজ আরেফিন বলেন, ‘আমার বাবা এই এলাকা থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। বিতর্কিত ওই নির্বাচনেও আমি দেড় লাখের ওপরে ভোট পেয়েছিলাম। দল মনোনয়ন না দিলেও আমার সমর্থকদের চাওয়া আমি যেন প্রার্থী হই। তাঁদের চাপেই প্রার্থী হয়েছি।’
নওগাঁ-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ইকরামুল বারী। এখানে তিনি ছাড়া মান্দা উপজেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মতিন ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য আক্কাস আলী মোল্লা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এম এ মতিন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও আক্কাস আলী মোল্লা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেননি।
নওগাঁ-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম। তিনি ছাড়া এখানে বিএনপির আরও ছয়জন নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। অন্যরা দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সমবায়বিষয়ক সম্পাদক নজমুল হক সনি।
নজমুল হক সনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময়েও নির্বাচন করে পরপর তিনবার নওগাঁ পৌরসভার মেয়র হয়েছি। এলাকার অধিকাংশ নেতা-কর্মী মনে করেন, এখানে সঠিক লোককে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমার কর্মী-সমর্থকেরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনও করেছেন। কর্মী-সমর্থকদের চাপেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি।’
নওগাঁ-৬ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনবারের সাবেক এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। তবে কিন্তু দল মনোনয়ন দেয় আত্রাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি শেখ রেজাউল ইসলাম। ৩ ডিসেম্বর প্রার্থী ঘোষণার পরপরই ফেসবুক লাইভে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন আলমগীর কবির। ইতিমধ্যে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
আলমগীর কবির বলেন, ‘কালোটাকাকে মোকাবিলা করার জন্য নির্বাচনে এসেছি। টাকার ইলেকশনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। রাজনীতিতে যারা সততা ও দেশপ্রেম দেখাতে পারবে না, তাদের রাজনীতি থেকে চলে যাওয়া উচিত। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় আমার প্রধান লক্ষ্য। আত্রাই রানীনগরের মানুষ আমাকে চায় দেখেই নির্বাচনে এসেছি।’
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শেখ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আলমগীর কবির আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা। তিনি এক-এগারোর সময় দল ছেড়ে এলডিপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে এলাকায় নিষ্ক্রিয়। এখন এলাকায় তাঁর তেমন জনপ্রিয়তা নেই। ভোটে জয়ী হওয়ার বিষয়ে দলের নেতা-কর্মী ও আত্রাই-রানীনগরের সাধারণ ভোটারদের প্রতি আমার আস্থা আছে।’
নওগাঁর ছয়টি আসনে বিএনপি মনোনীত ছয়জন ও স্বতন্ত্র হিসেবে বিএনপির ছয়জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাকি ২৯ জনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ছয়জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ছয়জন, জাতীয় পার্টির পাঁচজন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) দুজন, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির দুজন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) একজন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একজন, খেলাফত মজলিসের একজন, বিএনএফের একজন, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টির একজন ও স্বতন্ত্র হিসেবে তিনজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।