
নবতিপর হালিমা বেগম বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। থাকেন ছোট্ট একটা ঝুপড়িতে। মাটি ছুঁই ছুঁই একটি চৌকির ওপর প্লাস্টিকের কয়েকটি বয়াম ও প্লেট। তেলচিটচিটে একটি বালিশ, একটি কম্বল ও এক প্রান্তে প্লাস্টিকের একটি বস্তা। ঘরের এক কোনায় প্লাস্টিকের কমোডওয়ালা চেয়ার বসানো। একচালা ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে। মেঝেতে ইঁদুর মাটি উঠিয়েছে। প্রায় অন্ধকার ঘরটির মাথার ওপর বাঁশের সঙ্গে ঝুলছে একটি টেবিল ফ্যান। জীবনসায়াহ্নে এই ঘরের চৌকিতে শুয়ে-বসে কাটছে তাঁর সময়।
হালিমার ঝুপড়ির সঙ্গে দুই ছেলের আধা পাকা ঘর। সেখানে বৃদ্ধ মায়ের জায়গা হয়নি। পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিরা সেখানে বসবাস করেন। ছোট্ট চৌকিতে শুয়ে-বসে তাঁদের হাঁটাচলা দেখেন হালিমা। দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। বৃদ্ধার চার মেয়ে ও তিন ছেলে। তাঁদের মধ্যে দুটি ছেলে মারা গেছেন। বাকি পাঁচজনের কেউ ঠিকমতো খবর রাখেন না।
হালিমা বেগমের বাড়ি জামালপুর পৌর শহরের ফুলবাড়িয়া এলাকায়। স্বামী মফিজ উদ্দিন প্রায় ৪৫ বছর আগে মারা গেছেন। কাঁচামাল ব্যবসায়ী স্বামীর মৃত্যুর পর হালিমাই কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছেন। মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট শহীদ শেখ ঢাকায় ব্যবসা করেন। সন্তানদের সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিলেন না। দুই পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিরা সামনে থেকে সরে গেলে আক্ষেপের কথা বললেন। বয়স্ক ভাতার টাকাটাও নাকি ছেলের কাছে আসে বলে জানালেন।
বয়সের ভারে হালিমার হাত-মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা হয় না। আগে লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে পারলেও এখন সেটাও পারেন না। ডান চোখে একেবারেই দেখেন না। আক্ষেপ করে হালিমা বলেন, ‘এই সংসারে কতই–না কষ্ট করেছি। নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজ সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি?’ এরপর হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
শেষ বয়সে এমন পরিণতি হলে এত কষ্ট করে সন্তান লালনপালন করে কী লাভ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হালিমা। তিনি বলেন, প্রায়ই তাঁর না খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিবেশীরা কিছু দিলে পুত্রবধূরা বকাবকি করেন। তাঁরা ঠিকমতো খাইতেও দেন না। তাঁরা আধা পাকা ঘরে থাকলেও সেখানে তাঁর জায়গা হয়নি। মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে দিলেও কেউ খোঁজ নেন না। তিনি বলেন, ‘এই বয়সে কত কষ্ট করি, তারা (সন্তান) কখনো খোঁজ নিতে আসে না। এক চোখে কিছুই দেখি না। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে কাপড় শুকাতে হয়, প্রস্রাব-পায়খানায় যাই। তারপরও মায়ের জন্য তাদের হৃদয় কাঁদে না।’
বড় ছেলের স্ত্রী তাজমহল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছেন। আমিই সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। আমিই চলতে পারি না। তবে এটা ঠিক, তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁকে সেভাবে দেখে না। সেভাবে দেখলে তো আর তাঁকে এই অবস্থায় থাকতে হতো না। দুটি ছেলের বউ আছে। তার মধ্যে আমিও একজন। মিথ্যা কথা বলব না, আমরাও তাঁকে ওভাবে দেখতে পারি না।’
জানতে চাইলে ছোট ছেলে শহীদ শেখ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন বাড়িতে ছিলাম, তখন নিজে মাকে ভাত তুলে খাওয়াতাম, প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করতাম। কিন্তু আমার বোনেরা কখনো মায়ের খোঁজখবর নেয় না। আমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর পুত্রবধূরাও মাকে দেখাশোনা করে না। বিশ্বাস করেন, আমি কখনোই মাকে অযত্ন করি নাই।’ বয়স্ক ভাতার টাকার বিষয়ে বলেন, ‘মায়ের কাছে টাকা থাকলে হারিয়ে ফেলে। আবার তাঁর ঘর থেকে টাকা কেউ নিয়ে যায়। এ জন্য টাকাটা আমি ওঠাই। মায়ের ওষুধপথ্য কিনে দিই এবং বাড়িতে গেলে হাতে টাকা দিয়ে আসি। তবে মা যদি সব টাকা তার কাছে রাখতে চায়, আমি মাকে সব টাকা দিয়ে দেব।’
জামালপুরের মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, জরাজীর্ণ খুপরিতে ওই নারী বসবাস করেন। অথচ পাশেই দুই ছেলের আধা পাকা ঘর। কোনো সন্তানই তাঁকে দেখেন না। তিন বছর আগে তিনি ওই বৃদ্ধা মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। একটি হুইলচেয়ার ও বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, ভাতার টাকাও তিনি ভোগ করতে পারেন না। তাঁকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঘোরাফেরা করাবে—এমন মানসিকতার লোক নেই। অথচ পুত্রবধূ ও নাতিনরা আছেন। ছেলেটা মায়ের খোঁজ রাখেন না বলে এলাকার অনেকে অভিযোগ করেছেন। তাঁর পুনর্বাসনে বিত্তবানরা ভূমিকা রাখতে পারেন।
সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. শাহাদৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সুবিধাভোগী প্রাপ্য ভাতার টাকা না পেলে তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে নতুন করে নিবন্ধিত সিম দেবেন এবং পুরোনো সিমের নিবন্ধন বাতিল করবেন। এ ছাড়া ওই নারীকে আরও কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, তা দেখবেন।