যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের আমডাঙ্গায় ইপিজেড এলাকায় খাল খনন করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা
যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের আমডাঙ্গায় ইপিজেড এলাকায় খাল খনন করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা

যশোর ইপিজেডে জমি অধিগ্রহণ: ‘টাকা না পেলে ঘরবাড়ি ফেলে আমরা কোথায় উঠব’

যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নে যশোর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ (ইপিজেড) এলাকায় খাল খননের কাজ চলছে। উপজেলার বালিয়াডাঙ্গার ধলিয়ার বিল থেকে শুরু হয়ে মহাকালের আমডাঙ্গা খাল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির প্রায় ৪০০ মিটার খনন শেষ হয়েছে। খালের মধ্যে পড়েছে দুটি পরিবারের ভিটামাটি ও বসতঘর। ওই দুটি পরিবার এখনো জমি, বাড়ি ও ফসলের ক্ষতিপূরণ পায়নি।

ওই দুটি পরিবারসহ বেশির ভাগ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। অনেকের বসতবাড়ির জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাঁদের নতুন ঠিকানায় যেতে হবে। অনেকে অধিগ্রহণ করা জমিতে বোরো মৌসুমে ধান চাষ করতে পারেননি।

জমি হুকুমদখল কর্তৃপক্ষ বলছে, জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত জমি, বাড়ি ও ফসলের মালিকেরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন চলমান। ইতিমধ্যে ১৪৬ জনকে চেক হস্তান্তর, অ্যাকাউন্টস অফিসে ৪৪ জনকে চেক প্রদান এবং প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে আরও ৯ জন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৯৯ জনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

১. অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নে ৯০৬ একর জমিতে ইপিজেড নির্মাণ হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দিতে দেরি হচ্ছে।২. এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।৩. ৩৫০ জনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১৯৯ জন যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন।

যশোর ইপিজেড স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইউসুফ পাশা বলেন, জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর যশোরের জেলা প্রশাসককে ২৬৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে জমির মালিকেরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন। ইপিজেডের কাজ চলমান। খাল খনন চলছে। বালু ভরাট ও রাস্তা নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, ইপিজেডের জমি অধিগ্রহণ করে প্রত্যাশী সংস্থাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও জমির ক্ষতিপূরণ দুটি আলাদা বিষয়। জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এখন সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাগজপত্র দেখা হচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে জমির মালিকেরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন। দ্রুততার সঙ্গে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হবে। তবে টাকা নিতে হবে ক্লিন হ্যান্ডে।

ইপিজেড প্রকল্পে বসতবাড়ির জমি অধিগ্রহণ করে খাল খনন শুরু হয়েছে। খালের দুই ধার ঢালাইয়ের জন্য ইটের খোয়া ভাঙা হচ্ছে

আইনে কী বলা আছে
স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭–এর ১৩ ধারার উপধারা ১ ও ২–এ বলা হয়েছে, ‘ধারা ১১ অনুসারে রোয়েদাদকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হলে বা প্রদান করা হয়েছে মর্মে বিবেচিত হলে অধিগ্রহণকৃত স্থাবর সম্পত্তি দায়মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিকট ন্যস্ত হবে এবং জেলা প্রশাসক উক্ত সম্পত্তির দখল গ্রহণ করবেন। কোনো স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণের পর জেলা প্রশাসক নির্ধারিত ফরমে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন।’

ধারা ১১–এর উপধারা ১ ও ৩–এ বলা হয়েছে, ‘রোয়েদাদ প্রস্তুতের পর, দখল গ্রহণের পূর্বে, প্রত্যাশী ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ক্ষতিপূরণ মঞ্জুরির প্রাক্কলিত অর্থ জমা প্রদানের অনধিক ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসক উক্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করবেন।’

‘ক্ষতিপূরণের দাবিদার ক্ষতিপূরণের অর্থ গ্রহণ করতে অসম্মত হলে অথবা ক্ষতিপূরণ গ্রহণের জন্য কোনো দাবিদার পাওয়া না গেলে অথবা ক্ষতিপূরণ দাবিদারের মালিকানা নিয়ে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হলে অথবা ক্ষতিপূরণের অংশ নির্ধারণে কারো কোনো আপত্তি থাকলে, জেলা প্রশাসক ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাবে জমা রাখবেন যা, কোনো পক্ষের আরবিট্রেটর কর্তৃক নির্ধারিতব্য দাবিকে ক্ষুণ্ণ না করে, সংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তির দখল গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিশোধিত বলে গণ্য হইবে।’

যশোর ইপিজেড
২০১৯ সালের নভেম্বরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া, মহাকাল, প্রেমবাগ, বালিয়াডাঙ্গা, আমডাঙ্গা, আরাজি বাহিরঘাট, মাগুরা ও রাজাপুর মৌজায় ৫০২ দশমিক ৯০৬ একর জমিতে যশোর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৬৭৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি তিন বছরের। এটি ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা।

ইপিজেডের খালপাড়ে একদিন
৩ ফেব্রুয়ারি গিয়ে দেখা যায়, ইপিজেডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। সীমানা ঘেঁষে লাল কালিতে ‘বেপজা’ লেখা কংক্রিটের সীমানা পিলার পোঁতা হয়েছে। সীমানার মধ্যে মাছের ঘের, ধানের জমি, বাড়ি ও বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা রয়েছে। এক পাশে খাল খনন করা হচ্ছে। প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালের প্রস্থ ৬ মিটার। খালের উৎসমুখে গভীরতা ২ মিটার এবং সংযোগস্থলে ৩ মিটার। বালিয়াডাঙ্গার ধলিয়ার বিল থেকে শুরু হয়ে খালটি মহাকালের আমডাঙ্গা খালে পড়বে। সম্পূর্ণ খালটি আরসিসি ঢালাই হবে। ইতিমধ্যে কাজের প্রায় ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ
খালের মধ্যে পড়েছে দুটি পরিবারের বসতঘর। একটি বাড়ির মালিক উপজেলার আমডাঙ্গা গ্রামের বাবলু মোল্যা বলেন, ‘আমার ২ বিঘা ২১ শতক জমি এই প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে ২ বিঘা ধানিজমি এবং ২১ শতক ভিটামাটি। সেখানে আমার বসতঘর রয়েছে। খাল কাটতে কাটতে ঘরের কাছে চলে এসেছে। আমার সিরিয়াল নম্বর ৯। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের কোনো টাকা পাইনি। টাকা না পেলে কোনো অবস্থাতেই বাড়িঘর ভাঙতে দেব না।’

বাবলু মোল্যার প্রতিবেশী মুর্শিদা বেগমের ১৩ শতক জমিতে রয়েছে আধা পাকা ঘর। এই বাড়ির মধ্যে থাকা আটটি নারকেলগাছ, চারটি আম, চারটি সফেদা, একটি জাম আর ১২টি খেজুরগাছের মূল্য ২৭ হাজার টাকা। জমি শতকপ্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনো টাকা পাননি।

মুর্শিদা বেগম বলেন, ‘টাকাপয়সা না পেলে ঘরবাড়ি ফেলে আমরা কোথায় উঠব। জমি কিনে বাড়িও বানাতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের একটি টাকাও দেয়নি সরকার। ক্ষতিপূরণের টাকা না পেলে খালের কাজ বন্ধ করে দেব।’

খাল খননের কাজ করছে ঢাকার হোসেন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। খাল খননের কাজ তদারকি করছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে খাল কাটা হচ্ছে। জানুয়ারির ১১ তারিখ খননকাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে এক কিলোমিটারের মধ্যে ৪০০ মিটার খননের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই খালের মধ্যে ৪৩ জনের জমি রয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। খাল কাটার শুরুতে জমির মালিকেরা বাধা দিয়েছিলেন। তাঁদের বুঝিয়ে আমরা খাল খনন করছি।’

ক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকেরা
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ছাকিব হোসেনের পারিবারিক প্রায় ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি কোনো টাকা পাননি। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে কাগজপত্র জমা দিয়েছি। অথচ এখনো আমাদের অধিগ্রহণের টাকা দেওয়া হয়নি। কয়েক দিন আগে এই এলাকায় জমির মালিকদের উদ্দেশে মাইকিং করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ওই জমিতে কেউ যেন নতুন করে চাষাবাদ না করেন এবং যাঁদের ঘেরে মাছ রয়েছে, তাঁরা সেগুলো ধরে ফেলেন। ঘোষণার পর ৪২ শতকে বিঘা ওই জমির প্রায় ১০ বিঘায় এবার বোরো করতে পারিনি। এতে কমপক্ষে এক হাজার মণ ধান হতো। একই সঙ্গে ১৫ বিঘার ঘেরে মাছও ছাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। এতে আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

মহাকাল গ্রামের দিলীপ ঘোষের জমি রয়েছে ১০ শতক। তাঁর সিরিয়াল নম্বর ২১১। তিনিও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তিনি বলেন, ‘একজনের সিরিয়াল ৫৫৫। তিনি টাকা পেয়েছেন। অথচ আমি টাকার জন্য ঘুরছি।’

৫ ফেব্রুয়ারি যশোর কালেক্টরেট ভবনে জমি অধিগ্রহণ শাখার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বনগ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম। ইপিজেডে তাঁর ৩৮ শতক জমি পড়েছে। সিরিয়াল নম্বর ১৯৬। তিনি বলেন, ‘এই বারান্দায় ঘুরছি বহুদিন ধরে। যখনই আসি, বলে পরের সপ্তাহে আসেন। কমপক্ষে ১০ বার এখানে এসেছি। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না।’

ইপিজেড প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত জমিতে বোরো ধান চাষ না করার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। এ জন্য অনেক জমি অনাবাদি পড়ে আছে

কর্মকর্তা যা বলছেন

যশোরের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌসি বলেন, প্রায় ১ হাজার ৬০০ আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১৪৬ জনকে ২০ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ৫১২ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। হিসাবরক্ষণ অফিসে ৪৪টি চেক পাঠানো হয়েছে এবং প্রক্রিয়ায় রয়েছে ৯টি। সব মিলিয়ে ১৯৯ জনের চেক বিতরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬০০ আবেদন পড়েছে। তার মধ্যে ৩৫০ জনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১৯৯ জন যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৪৬ জনকে চেক দেওয়া হয়েছে। ১৫১ জন চেক পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন।

সুজন সরকার আরও বলেন, ‘জমির মালিকানা নির্ধারণে সমস্যা রয়েছে। অনেকের জমি নিয়ে মামলা রয়েছে, অনেকের কাগজপত্রে সমস্যা রয়েছে, কেউ কেউ জমির মালিকই নন, কেউ জমি কিনে বিদেশে গেছেন, তাঁর পক্ষে স্বজনদের কেউ আবেদন করেছেন, আবার কেউ জমি বিক্রি করেও আবেদন করেছেন আবার যিনি কিনেছেন, তিনিও আবেদন করেছেন। এ জন্য যাচাই-বাছাই করে জমির প্রকৃত মালিককে চেক দিতে কিছুটা সময় লাগছে। আশা করছি, জুনের মধ্যে বেশির ভাগ যোগ্য মালিক জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যাবেন।’