রাজশাহীর তানোরে ‘আলোকিত মানুষ রাজশাহীর তানোরে ‘আলোকিত মানুষ সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট হাতে গুণীজন হাসিনা বানু (ডানে), সোহরাব আলী, রঞ্জিত পাল ও সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। গতকাল শনিবার বিকেলে তানোর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে
রাজশাহীর তানোরে ‘আলোকিত মানুষ রাজশাহীর তানোরে ‘আলোকিত মানুষ সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট হাতে গুণীজন হাসিনা বানু (ডানে), সোহরাব আলী, রঞ্জিত পাল ও সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। গতকাল শনিবার বিকেলে তানোর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে

নিভৃত গ্রামের চার স্বশিক্ষিতকে ‘আলোকিত মানুষ সম্মাননা’

সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি। মায়ের কাছে পড়তে শিখেছিলেন। তবে লেখা শেখা হয়নি। শুধুই পড়তে পারেন। গান করেন, ছবি আঁকেন। মুখে মুখে গানও বাঁধেন। স্বশিক্ষিত সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক পেশায় কৃষক। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলায়।

এই উপজেলায় সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিকের মতো আরও তিনজন আলোকিত মানুষের সন্ধান মিলেছে, যাঁদের একজন পেশায় কুমার, একজন কৃষক ও একজন গৃহিণী। তাঁদের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কিন্তু ঘরে বসে তাঁরা বিশ্বসাহিত্য চর্চা করছেন। গতকাল শনিবার বিকেলে তাঁদের সম্মাননা জানানো হয়েছে। বরিন সাহিত্য সংসদের পত্রিকা ‘বরিনের বাতিঘর’–এর প্রকাশনা উৎসবে তানোর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘আলোকিত মানুষ সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, প্রতিষ্ঠিত কবি–সাহিত্যিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

সম্মাননাপ্রাপ্ত চারজন হলেন সোহরাব আলী, সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক, রঞ্জিত পাল ও হাসিনা বানু। তবে এই আয়োজনের মধ্যমণি ছিলেন ঔপন্যাসিক মঈন শেখ। তিনি বরিন সাহিত্য সংসদের সভাপতি। দুই বাংলায় তাঁর উপন্যাস সমান সমাদৃত। তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। থাকেন তানোরে, কিন্তু তাঁর বই বের হয় কলকাতা থেকে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিয়াকত সালমান। প্রধান অতিথি ছিলেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক উদয় শঙ্কর বিশ্বাস, কবি মোস্তাক রহমান, উর্দু বিভাগের অধ্যাপক সামিউল ইসলাম, রাজশাহী উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক আবদুস সবুর ও রাজশাহী সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তানভীর হক ও সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ।

সত্যেন প্রামাণিকের বাড়ি তানোর উপজেলার মাহাড়িয়া গ্রামে। থাকেন জরাজীর্ণ মাটির ঘরে। পড়েন দর্শন, নৃতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান। তিনি একই সঙ্গে একজন চিন্তক, কণ্ঠশিল্পী এবং আঁকিয়ে। তবে তিনি সন্তানদের মানুষ করেছেন। তাঁর ছেলে পাস করেছেন বুয়েট থেকে আর মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। অনুষ্ঠানে সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক বললেন, ‘আমার মতো তুচ্ছ মানুষকে মঞ্চে ডেকে এই সম্মাননা দেওয়ার জন্য আমি বরিন সাহিত্য সংসদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ বেশি কথা না বলে দরাজ কণ্ঠে গাইলেন নজরুলের একটি গান—‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল।’

হাসিনা বানুর বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে। বাল্যবিবাহ হয়েছিল। এক বছরের মাথায় স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনি চিরদিনের মতো বাবার বাড়িতে চলে আসেন। নিঃসঙ্গ জীবনে হাতে তুলে নেন বই। লিখেছেন কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। ২০০৭ সালে এডিডির সহযোগিতায় ‘মোর মনের মাধুরী’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ভূমিকা লিখে দেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। তাঁর উপস্থিতিতে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে এই গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। গতকাল অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘আমি ভালো কথা বলতে পারি না। আমাকে এই সম্মাননা দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ ‘আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই’ বলে নিজের একটি কবিতা পড়ে শোনান।

গুণীজন হাসিনা বানুর হাতে ক্রেস্ট ও বই তুলে দিচ্ছেন অতিথিরা। গতকাল শনিবার বিকেলে তানোর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে

সোহরাব আলীর বাড়ি তানোর উপজেলার মাদারীপুর গ্রামে। তিনি কৃষকের জন্য গণসংগীত লেখেন। সম্মাননার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিশ্বসাহিত্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে জীবনমুখী কিছু কথা বলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রক্ষী বাহিনীর ভয়ে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। ভয়ে তাঁর বাবা তাঁর সংগৃহীত বইগুলো সব নর্দমায় ফেলে দেন। এই দুঃখের কথা বলতে গিয়ে তিনি পৃথিবীতে বড় বড় সাহিত্যিকের বই হারানো নিয়ে মজার মজার তথ্য তুলে ধরে চমৎকার বক্তব্য দেন। একপর্যায়ে বললেন, ‘আমি অনেক মানুষকে বই পড়তে দিয়েছি। কিন্তু এই সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক ছাড়া কেউ আমার বই ফেরত দেননি। বিশেষ করে শিক্ষিত লোকেরা বই নিয়ে গেলে আর ফেরত দেননি।’

রঞ্জিত পালের বাড়ি তানোর উপজেলার শ্রীখণ্টা গ্রামে। তাঁর বই রাখার জায়গা নেই। সে কথা শোনালেন তিনি। তাঁর মেয়ে ঘর লেপে দেওয়ার সময় বইগুলো মাটিতে রেখেছিলেন। উইপোকাই সব বই খেয়ে ফেলেছে। এসব কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন রঞ্জিত পাল।

অনুষ্ঠানের অতিথিরা তানোরে নিভৃত গ্রাম থেকে এই চার স্বশিক্ষিতকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য ঔপন্যাসিক মঈন শেখকে ধন্যবাদ জানান। তাঁরা বলেন, পড়াশোনার সুযোগ না পেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়নি বলে সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক, সোহরাব আলী, হাসিনা বানু ও রঞ্জিত পাল পড়ালেখা বন্ধ করেননি। প্রতিভা থাকলে যেকোনোভাবে প্রকাশিত হবেই। তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে এই চারজন আলোকিত মানুষ।

অনুষ্ঠানে কবি দীপালি রানী সরকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই খালি গলায় একটি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন।