হাওরের পথে গরু নিয়ে চলছেন রাখাল। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে
হাওরের পথে গরু নিয়ে চলছেন রাখাল। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

হাওরপারে ‘শৈশবের ঘ্রাণ’ মাখানো রাঙা সকাল

অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে, সকালের নরম আলো গা এলিয়ে ধীরে ধীরে ফুটছে। তখনো রাঙা ভোর, তখনো পাখির ডাকে কেঁপে উঠছে গাছের পাতারা, ভাঙছে নৈঃশব্দ্য। পথে মানুষের চলাচল খুব সামান্য, অনেকেরই তখনো ঘুম ভাঙেনি। আচমকা এক–দুজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটছেন। কেউ হয়তো মাঠে যাবেন, খেতের আলপথে নেমে পড়ছেন। পথের পাশে মাঝেমাঝেই আগুনের দোলা, ঢেউ। ‘আগুনের মতো রাঙা ফুলের ঝরনায়/ কৃষ্ণচূড়া–গাছের সবুজ পাতা ঢাকা পড়ে গেছে সব...।’ শুধু কৃষ্ণচূড়া কেন, কিছু পরপরই মাঠের আলে, খালের পাড়ে, বাড়ির কাছে জারুলের ঘুমভাঙা ফুলকন্যারাও নির্দোষ হাসিতে ঢলে পড়ছে।

গাঁথা মালার মতো দুলে আছে হিজল ফুল। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতে

পথের দুই পাশে তখনো কিছু জমিনে ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা রেখে’। বিভিন্ন স্থানে খেতে দল বেঁধে ধান কাটছেন কিছু কৃষিশ্রমিক। তাঁরা ধান কেটে যখন বাড়ি ফিরবেন, খলায়-উঠানে অমন সোনার মতন ধান দেখে কারও হয়তো মনে জেগে উঠতে পারে, ‘আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। এ এক চিরন্তন বাংলা, এত হইচই, সমস্ত ওলট-পালট, অনেক ভাঙাচোরার আড়ালে আপন জগতে শুধু ফসলের সুখে বেঁচে থাকে কৃষকের মন।

গাছের নিচে রঙিন চাদর হয়ে আছে ঝরা ফুল। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতে

এই পথ গেছে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরের দিকে। একটা দীর্ঘ পথ, যে পথের দুপাশে ধানখেত, সারি সারি গাছপালা, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা। কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসছে মোরগের ডাক। গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে চলছে চেনা-অচেনা পাখির ঝাঁক। কোনো ঝাঁক চলছে হাওরের দিকে।

সকালবেলার শান্ত, নির্জন হাট। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি বাজার

গত শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট-একাটুনা সড়ক ধরে গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে কাউয়াদীঘি হাওরের কাছে গেলে দেখা মেলে সে আরেক খোলা দিগন্তের। কয়েক দিন আগেও ওই হাওরজুড়ে মানুষের অন্য রকম কোলাহল ছিল, উৎসব ছিল। কেউ ধান কাটছিলেন, কেউ ধানের আঁটি কাঁধে করে গন্তব্যের দিকে ছুটছিলেন।

দিনের শুরুতে শুকানোর জন্য বোরো ধান মেলে দিচ্ছেন এক ব্যক্তি। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

হাওরের মাঠের উজাড় হৃদয় এখন কিষান-কিষানির কাছে ফসল তুলে দেওয়ার প্রশান্তিতে নিঃশব্দ, নিঝুম। কেটে নেওয়া ধানের উপাখ্যান বুকে নিয়ে স্থির হয়ে আছে, শুয়ে আছে। ক্রমে রোদ বাড়ছে। তেতে উঠছে বৈশাখের বাতাস। তবে দমকা বাতাস আছে, তাতে হিজল-করচসহ জলাভূমির গাছেরা ঝিরিঝিরি শব্দ তোলে। গ্রামগুলো থেকে হাওরের দিকে গরুর পাল নিয়ে পথে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। তাঁরা ছোট-বড় পালে গরু নিয়ে হাওরের দিকে ছুটে চলছেন। সারা দিন গরুগুলো নিজের মতো করে চরে বেড়াবে, ঘাস খুঁটে খাবে। বিকেল হলে মালিকেরা গরুর পাল নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে ফিরবেন।

মাত্র খুলেছে গ্রামের পথের মোড়ের একটি দোকান। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

স্থানীয় লোকজন জানান, হাওর থেকে ধান তোলা শেষ হয়ে গেছে। এখন যেটুকু ধান আছে, তা হাওরপারের গ্রামের দিকের। এবার বোরো ফসল তাঁরা নিরাপদে গোলায় তুলতে পেরে খুশি। কোনো ঝুঁকি ছিল না। বন্যা, ঝড়বাদলের ঝুঁকিতে পড়েনি ফসল, রোদ ছিল। ধান কাটতে, শুকাতে কোনো সমস্যা ছিল না।

ফুটে আছে কচুরিপানার ফুল। তাতেই রূপ খুলেছে ডোবার। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

হাওরপারের অন্তেহরি বাজার তখনো শান্ত। কিছু দোকান খুলেছে। কিছু চায়ের স্টলে আড্ডা জমতে শুরু করেছে। গ্রামের দিক থেকে এক–দুজন করে বাজারে আসছেন, যাঁর যাঁর পছন্দের দোকানে বসছেন। কেউ সকালবেলার নাশতার জন্য শুকনা খাবার কিনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ধান তোলার কাজ শেষ হয়ে গেছে, বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা বেড়েছে হাওরপারে। তাঁরা শহর থেকে খুব সকালেই গাড়িতে করে দল বেঁধে হাওরপারের গ্রামে চলে আসেন। স্থানীয় ফেরিওয়ালাও আছেন। কারও কাছে আছে নানা রকম গুঁড়া মসলা। কারও কাছে প্রসাধনী, কারও কাছে পান-সুপারি। কেউ হাওরের শিং-মাগুর, বাইনসহ ছোট মাছ নিয়ে পথে বেরিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এগুলো বিক্রি করা হবে।

হাওরপারের গ্রামগুলোয় এখন অনেক রকম জলজ ফুল ফুটে আছে। বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ নয়—থোকায় থোকায় মুর্তা বেতের সাদা ফুল এখানে-ওখানে ফুটে আছে। আছে জালি বেতের সবুজ চকচকে ঝাড়। ঝোপে অচেনা বুনো ফুল আছে। অনেকগুলো জারুলগাছে বেগুনি রঙের ঢল, আছে কৃষ্ণচূড়া। কোথাও হিজল ফুল শাখে শাখে ঝুলে আছে। গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে গোল গোল বরুণ ফল, ফুল ঝরে গেছে কবে। খালগুলো এখনো পানিতে ভরে ওঠেনি। খালের ওপর জাল পেতে রেখেছেন কেউ, বৃষ্টি দিলেই শুরু হবে মাছ ধরা।

ধান কাটা হয়ে গেছে, খেতে মাঠে পড়ে আছে খড়। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

কোথাও খালের ওপর বাঁশের সাঁকো, সেই সাঁকো পার হয়ে লোকজন খালের এপার-ওপার হচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে কচুরিপানার ফুলে ভরে আছে ডোবা। রাশি রাশি সাদা-বেগুনি ফুলের পাপড়িতে সকালের রোদ শুয়ে আছে, ঝিকমিক করছে। পাতি কাকের দল ডাকতে ডাকতে কখনো মাটিতে নেমে আসছে, কখনো বিদ্যুতের তারে বসছে।

পথের শেই ফুটে আছে জারুল–কৃষ্ণচূড়া। দিনের কাজে একটু একটু করে ব্যস্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারে

গ্রামের কোনো বাড়ির ঠিকানা থেকে সাদা বক, পানকৌড়ি, শামুকখোলের ঝাঁক আকাশে ছবি এঁকে উড়ে চলছে হাওরের দিকে। ক্রমে ব্যস্ত হয়ে ওঠার আগে হাওরপারের গ্রাম মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’–এর পঙ্‌ক্তিগুলো। যেখানে বলা আছে, ‘চারিদিকে এখন সকাল/ রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল/ মাঠের ঘাসের প’রে শৈশবের ঘ্রাণ’।