মায়ের সঙ্গে নাসিমা আকতার (ডান থেকে দ্বিতীয়) ও তাঁর চার ভাই–বোন। ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি মনে আনন্দ এনে দেয়
মায়ের সঙ্গে নাসিমা আকতার (ডান থেকে দ্বিতীয়) ও তাঁর চার ভাই–বোন। ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি মনে আনন্দ এনে দেয়

নারীর জীবনে ঈদ

রান্না-খাওয়া পর্ব ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করলে নারীরাও আনন্দ করতে পারবেন

ঈদ মানে উৎসব। উৎসব মানে আনন্দ। বয়স, অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মানদণ্ডে আনন্দ উপভোগের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এই ধরুন, মফস্‌সল শহর রংপুরে আমার বেড়ে ওঠা। আমি একসময় ঈদ উদ্‌যাপন করেছি বাঁধনহীনভাবে। ছিল নির্মল আনন্দ। এখন বয়সের কারণে সেভাবে আর হয়ে ওঠে না।

রংপুর শহর ছিল তখন ছিমছাম, গোছানো। এখনকার মতো বড় বড় বহুতল ভবন, ঝলমলে শপিং মল, এত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা ছিল না। মা-বাবারাও সন্তানদের নিয়ে এত চিন্তা করতেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন পর্যন্ত মা–বাবার সঙ্গে নতুন কাপড় পরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। তাঁদের ছাড়া একা বেড়ানোর সাহস হয়নি। আমরা ঠিকাদারপাড়া কলেজ রোডে থাকতাম। মাধ্যমিকে এসে পাড়ার সমবয়সীদের নিয়ে দল বেঁধে এ বাড়ি–ও বাড়ি যেতাম। কলেজে এসে বেড়ানোর সীমানা বেড়ে গেল। রংপুরের বিভিন্ন পাড়ায় বান্ধবীদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম। আর ঈদে কার পোশাক কত সুন্দর, সেটা দেখা হতো!

আমার মা বা অন্য মায়েদের যেমন দেখেছি, ঈদ এলে হাসিমুখে রাজ্যের দায়িত্ব তাঁরা পালন করেন। ঈদ উৎসব সার্থক করতে আম্মাকে দেখতাম, বাড়িঘর পরিপাটি থেকে সাজগোজ, ধোয়ামোছা, কেনাকাটা, জাকাত দেওয়া, রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ততার কমতি নেই। ঈদের দিনে আমাদের সাজগোজ, পোশাক ঠিক আছে কি না, সেটি যেমন দেখতেন, তেমনি রান্নাবান্না, অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে আম্মা ব্যস্ত থাকতেন।

নামাজ শেষে আব্বা সঙ্গে করে পাড়ার মামা, চাচাদের নিয়ে আসতেন। নিজেদের আত্মীয়স্বজন আসত। আম্মা হরেক রকম সেমাই, পুডিং, মাংস, পোলাও দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। ঈদের পরেও কয়েক দিন ব্যস্ততায় কাটত। আম্মার কাজের সহকারী হানুফার কথা মনে পড়ে। তার কোনো ঈদ–আনন্দ ছিল কি না, কখনো জানা হয়নি। কারণ, তার তো বসে থাকারই ফুরসত ছিল না।

নাসিমা আকতারের (ডান দিক থেকে প্রথম) বড়বেলার ঈদ কাটে নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে

স্কুল–কলেজ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। ঈদ নিয়ে প্রত্যেকের কত পরিকল্পনা! সে যা–ই হোক, অপেক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবে ঈদের ছুটি দেবে। ওই সময় বাড়ি ফেরার অন্য রকম একটা টান অনুভব করতাম। মা, বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে ঈদ করার নতুন আনন্দ খুঁজে পেলাম, যেটি দূরে না যাওয়ায় আগে অনুভব করিনি।

ধীরে ধীরে পাড়ার চিত্রও বদলাতে থাকল। আগের মতো আমন্ত্রণ ছাড়া হুটহাট কেউ আর ঈদে বাসায় আসে না। একসময় আমিও মা হলাম। কিন্তু আফসোস, আমাদের সন্তানেরাও হইহল্লোড় করে পাড়ায় ঘুরতে বেরোয় না। এখন হাতে হাতে মুঠোফোন, সন্তানেরা বাইরে গেলে আমরা মা–বাবারা অস্থির হয়ে উঠি। কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েও সুস্থির থাকতে পারি না।

সময় অনেক বদলেছে। তবু অধিকাংশ মা-বোন প্রথাবদ্ধভাবে দিনরাত হেঁশেলে কাটান। অন্যান্য উৎসবের মতো ঈদ উৎসবকে সার্থক করতে নিজেদের সব সুখকে উজাড় করে দেন। নারীর কাছে ঈদ মানে শুধু রান্নাঘর, এই ধ্যানধারণাকে মুক্তি দেওয়ার সময় এখন। তাঁদের ঈদ–আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ ও পরিবেশ করে দেওয়া জরুরি। রান্না-খাওয়ার পর্ব ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করলে নারীরাও আনন্দ করতে পারবেন।

ঈদ উৎসব শুধু খাওয়া আর রান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে কোথাও থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। ঈদ উৎসব হোক নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব বৈষম্যহীন।

ঈদ এলেই স্মৃতির ঝিনুকে মুক্তোর মতো লুকিয়ে রাখা কিছু আবেগ, কিছু ভালোলাগা হাতড়িয়ে ফিরি। বিশেষ করে কৈশোরের উচ্ছল দিনগুলোর কথা, যখন সবাই একসঙ্গে বলতাম, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মাহীগঞ্জ কলেজ, রংপুর