
সম্প্রতি নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ ঘোষণার দাবিতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ জেলার সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব আব্দুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রি-নিকার বৈঠকে ফরিদপুর ও কুমিল্লা নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনের দাবিটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টিকটকে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ মিমের (হাস্যরসাত্মক ছবি, ভিডিও) ছড়াছড়ি। কানাডার টিকটকার বোরজাহ ইয়াংকিও এ নিয়ে টিকটকটি করতে ছাড়েননি। তবে এখন আর হাস্যরসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই নোয়াখালী বিভাগের দাবি। সম্প্রতি প্রশাসনিক বিভাগ ঘোষণার দাবিতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। মতভিন্নতা থাকলেও বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ জেলার সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ রাজপথে এই আন্দোলন জোরালো হওয়ার পেছনের কারণ কী? কী বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা?
যে কারণে বিভাগ আন্দোলন
সরকারি দপ্তরে পাওয়া নথি অনুযায়ী, নোয়াখালীর সাবেক নাম ছিল ভুলুয়া। ১৮২১ সালে নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে ভুলুয়া নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা গঠন করা হয়। পরে ১৮৬৮ সালে ভুলুয়ার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নোয়াখালী।
২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) বৈঠকে বৃহত্তর ফরিদপুরের কয়েকটি জেলা নিয়ে ‘পদ্মা বিভাগ’ এবং কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলো নিয়ে ‘মেঘনা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। তবে তখন চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে গত ৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব আব্দুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রি-নিকার বৈঠকে। ওই বৈঠকে ফরিদপুর ও কুমিল্লা জেলার নামেই নতুন দুটি প্রশাসনিক বিভাগ এবং নতুন দুটি উপজেলা গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনের দাবিটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
কুমিল্লা বিভাগের সঙ্গে নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদের উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রামেও এ নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। আন্দোলনে শামিল জেলার সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ নানা পেশার মানুষও।
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি সাইফুর রহমান জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা কুমিল্লার নামে বিভাগ করার বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকেই মূলত বৃহত্তর নোয়াখালীর মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়; যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা প্রথমে নোয়াখালীতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। এরপর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর, নোয়াখালীতে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন চত্বর, সোনাইমুড়ী বাইপাস, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, নোয়াখালীর চাটখিল, সোনাইমুড়ী, সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর, বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে, চৌমুহনী চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়। কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসেও নোয়াখালী বিভাগের দাবিতে আন্দোলন করেছেন প্রবাসীরা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বিভাগের দাবি নিয়ে একাধিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। ওই সব কর্মসূচিতে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র বিভাগ ঘোষণা করা হবে।
বিভাগের দাবি নতুন নয়
নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ ঘোষণার দাবি এখনকার নয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে নানা পরিসরে এই দাবি উঠতে থাকে। নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি সাইফুর রহমানের মতে, ১৯৯৪ সালে আইনজীবী আবুল কালামের নেতৃত্বে নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৪ সালের ১ নভেম্বর মাইজদী কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে ১০ দফা দাবিতে গণ-অনশনসহ একটি বড় কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর ২০১২ সালে ‘নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। তবে এবারের মতো এমন জোরালো ছিল তখনকার কর্মসূচি।
শুধুই কি ভোটের রাজনীতি
আর কয়েক মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা ভোটারদের কাছে যেতে চেষ্টা করছেন। তাই নোয়াখালী বিভাগের ইস্যুতে সরব হয়েছেন তাঁরাও।
তবে বিষয়টি কেবল ভোটের রাজনীতি নয় বলে দাবি রাজনৈতিক দলে নেতাদের। তাঁরা বলছেন, জেলাজুড়ে যেহেতু বিভাগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তাঁদের মতে, নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলন এখন গণদাবি। যেখানেই বিভাগ আন্দোলন, সেখানেই তাই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত থাকার চেষ্টা করছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বিভাগের দাবি নিয়ে একাধিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। ওই সব কর্মসূচিতে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র বিভাগ ঘোষণা করা হবে।
নোয়াখালীর প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরিদপুর যদি বিভাগ হতে পারে, নোয়াখালী বিভাগের যৌক্তিকতা রয়েছে। নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবি বহুকাল আগের। সেখানে নোয়াখালীর নাম বাদ দিয়ে কুমিল্লার নামে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। সম্প্রতি সরকারের একটি বৈঠকে নতুন দুটি বিভাগ বাস্তবায়নের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করায় এখানকার মানুষের অনুভূতিতে লেগেছে। কারণ, আমাদের দাবি তো বহুকাল আগের। নোয়াখালী বিভাগের দাবি কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়, এটি এখানকার জনমানুষের প্রাণের দাবি। আমরাও রাজনৈতিক দল হিসেবে এই দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাব।’
একই কথা বলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, এই জেলার মানুষের প্রতি আমাদের একটি কমিটমেন্ট আছে। তাঁদের সঙ্গে আমরা চলাফেরা করি। তাঁদের মনের ভাষা, মনের আবেগ অনুভূতি আজ বিভাগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক একজন কর্মী হয়ে তাঁদের পাশে থাকা, একাত্মতা প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব।’
‘ফরিদপুর যদি বিভাগ হতে পারে, নোয়াখালী বিভাগের যৌক্তিকতা রয়েছে। নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবি বহুকাল আগের। সেখানে নোয়াখালীর নাম বাদ দিয়ে কুমিল্লার নামে বিভাগ করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। সম্প্রতি সরকারের একটি বৈঠকে নতুন দুটি বিভাগ বাস্তবায়নের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করায় এখানকার মানুষের অনুভূতিতে লেগেছে।’মো. শাহজাহান, কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি
কথা হয় জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির ইসহাক খন্দকারের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবি এখন একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। জনগণকে নিয়েই যেহেতু আমাদের রাজনীতি, সেহেতু আমরাও এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। তা ছাড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে নোয়াখালী একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জেলা। এই নোয়াখালীকে ঘিরে বিভাগ দাবি করা খুবই প্রাসঙ্গিক।’
৯ অক্টোবর বিকেলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত বাইকারদের এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ নোয়াখালী বিভাগের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমি এনসিপির নেতা হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনে পাশে থাকতে চাই। নোয়াখালীর মানুষ কখনো কুমিল্লার সঙ্গে বিভাগে যেতে রাজি নয়।’
বিভাগের পক্ষে যত যুক্তি
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি সাইফুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন নোয়াখালী ও আশপাশের অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ করা প্রয়োজন? জবাবে তিনি বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালী (নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর) চট্টগ্রাম বিভাগের অংশ হওয়ায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। ৮০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত এই এলাকা বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে বেশ দূরে। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই এলাকার মানুষ।
সাইফুর রহমান আরও বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। বিভাগীয় সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো রয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষি, প্রবাসী আয় এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কারণে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। একটি স্বতন্ত্র বিভাগ এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত করবে।