ময়মনসিংহে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে মাসকান্দা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে না যাওয়ায় ঢাকাগামী যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। শনিবার সকালে
ময়মনসিংহে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে মাসকান্দা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে না যাওয়ায় ঢাকাগামী যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। শনিবার সকালে

ময়মনসিংহে পরিবহন ধর্মঘট

‘খুব টেনশন হচ্ছে, কীভাবে গন্তব্যে যাব?’

ঢাকায় যাবেন নির্মাণশ্রমিক রঞ্জু মিয়া। তাই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা রাধাকানাই থেকে আজ রোববার সকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে শহরের মাসকান্দা বাস টার্মিনালে আসেন। কিন্তু এসে দেখেন ঢাকার উদ্দেশে কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না। তাই ঢাকায় যাওয়া হয়নি তাঁর।

জুলাইযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার জেরে ময়মনসিংহে এনসিপির নেতা-কর্মী ও পরিবহনশ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কর্মসূচির পর এখনো ময়মনসিংহ থেকে বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। আজ রোববার সকাল থেকে ময়মনসিংহ থেকে সব ধরনের বাস বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহনশ্রমিক ও নেতারা। এতে বিপাকে পড়েছেন রঞ্জু মিয়ার মতো বহু মানুষ।

রঞ্জু মিয়ার প্রশ্ন, যানবাহনের মালিক-শ্রমিকেরা নিজেদের দাবি–দাওয়া নিয়ে কথা বলবে প্রশাসনের সঙ্গে। কিন্তু বাস বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের কেন ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে?

সমস্যার শুরু গত শুক্রবার সন্ধ্যায়। এনসিপির হালুয়াঘাট উপজেলার প্রধান সমন্বয়কারী জুলাইযোদ্ধা আবু রায়হানকে ইউনাইটেড পরিবহনের শ্রমিক লাঞ্ছিত করেছেন—এমন অভিযোগে এনসিপির নেতা-কর্মীরা গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ময়মনসিংহের মাসকান্দা বাস টার্মিনালে অবস্থান নেন। আর এনসিপি নেতা-কর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি ও এক শ্রমিককে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা থেকে বিক্ষোভে নামেন পরিবহনশ্রমিকেরা। এতে ময়মনসিংহ থেকে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে, দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।

এরপর গতকাল বিকেলে জেলা প্রশাসন শ্রমিক নেতা ও এনসিপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হকের (শামীম) মালিকানাধীন ইউনাইটেড পরিবহনের ১৬টি গাড়ি বন্ধ করে দেওয়ার আশ্বাস দিলে এনসিপি নেতারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। আর গাড়ি চলাচলে কেউ বাধা দেবেন না—এমন আশ্বাসে শ্রমিকেরাও গতকাল বিকেলে সড়ক থেকে সরে যান। কিন্তু বিকেল পাঁচটা থেকে ইউনাইটেড পরিবহনের ৭০টি ও শৌখিন এক্সপ্রেসের ১৫০টি বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আজ রোববার সকালে ময়মনসিংহ থেকে সব বাস বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহনশ্রমিক ও নেতারা।

ময়মনসিংহ নগরের মাসকান্দা বাস টার্মিনাল, দীঘারকান্দা বাইপাস ও পাটগুদাম ব্রিজ মোড় বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের চিত্র। বাস না পেয়ে অনেকে অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যানে গন্তব্যের দিকে রওনা হন। আবার অনেকে বাস না পেয়ে বাড়ি ফিরে যান। তাঁদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবায়েত জাহান।
আজ সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে কথা হয় রুবায়েতের সঙ্গে। তিনি জানান, আজ থেকে তাঁর ক্লাস শুরু। কিন্তু মাসকান্দা বাস টার্মিনালে এসে দেখেন বাস চলছে না। তাই বাসায় ফিরে যেতে হচ্ছে।

ছোট ভাই রাফিউর হাসানকে টঙ্গীর মাদ্রাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন জুনায়েদুল ইসলাম। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তিনি বলেন, ‘তারাকান্দা থেকেও কোনো বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছে না। ভেঙে ভেঙে এখানে এসেছি। কিন্তু এখান থেকেও বাস যাচ্ছে না। সে কারণে খুব টেনশন হচ্ছে, কীভাবে গন্তব্যে যাব?’

নগরের দীঘারকান্দা বাইপাস এলাকা হয়ে ঢাকাগামী যানবাহন চলাচল করে। সেখানে গিয়েও দেখা যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে বহু মানুষ। কিন্তু কোনো বাস নেই।

মাসকান্দা বাস টার্মিনালে দেখা যায়, ইউনাইটেড ট্রান্সপোর্টের কাউন্টারের সামনে ব্যানার টানিয়ে শ্রমিকেরা অবস্থান করছেন। সেখানে ব্যানারে লেখা, ‘পরিবহনশ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার দাবিতে অনশন ধর্মঘট। মিথ্যা অপবাদে শ্রমিকের পেটে লাথি মারা মানব না। ষড়যন্ত্র করে গাড়ি বন্ধ করা চলবে না। ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তার চাই। শ্রমিক ও যাত্রী হয়রানি থেকে মুক্তি চাই।’

দাবির বিষয়ে প্রতিশ্রুতি পেয়ে অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে এসেছিলেন বলে জানিয়ে জেলা এনসিপির সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার কোনো পরিবহন বন্ধের পক্ষে নই, শুধু ফ্যাসিস্ট শামীমের ১৬টি গাড়ি আমরা বন্ধের পক্ষে। কিন্তু তাঁরা (পরিবহনশ্রমিক ও মালিকরা) কেন ফ্যাসিস্টের পক্ষে সব গাড়ি বন্ধ রেখেছেন, তা বোধহগম্য নয়। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে তাঁরা এখানে একটি ষড়যন্ত্র করছেন।’

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাস চলাচল বন্ধ রাখা মালিকদের সিদ্ধান্তের বিষয়। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার আলোচনা করছেন।

ময়মনসিংহ থেকে সব রুটে বাস চলাচলের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত সেল ময়মনসিংহ এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক নেতারা। শনিবার বিকেল চারটায় ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে

বাস চালু করতে সময়সীমা

চলমান পরিস্থিতিতে যাত্রী ভোগান্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে আজ রাত আটটার মধ্যে বাস চলাচল শুরু করতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতারা।

আজ বিকেলে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহীদ ও আহত সেল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সেলের সমন্বয়কারী আল নূর মোহাম্মদ আয়াস।

লিখিত বক্তব্যে আল নূর বলেন, সম্প্রতি ময়মনসিংহে বাস চলাচলে অসংখ্য অনিয়ম ও সিন্ডিকেটজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরের নির্দেশে কয়েকটি বাসমালিক বিকল্প কর্মসূচি ঘোষণা করে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। এতে সাধারণ যাত্রী ও জনগণ বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়েছেন। এ ধরনের সিন্ডিকেটজনিত কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহবাসীর যাতায়াত ও দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করছে। তাই দ্রুত সমস্যার সমাধান এবং স্বাভাবিক পরিবহনব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সাত দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরদের কোনো বাস ময়মনসিংহ শহরে চলতে পারবে না এবং যারা সিন্ডিকেট চালাচ্ছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ময়মনসিংহে উন্নত মানের বাসের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা সরকারি ছুটিতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে হবে। বাসশ্রমিকদের চিকিৎসা, সাপ্তাহিক ছুটি এবং জীবনমানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি জেলায় শ্রমিকদের রাতযাপন ও বিশ্রামের জন্য বিশ্রামাগার তৈরি করতে হবে। আজ রাত আটটার মধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলো থেকে ঢাকা যাওয়ার সব বাস স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে হবে। অন্যথায় মোটর মালিক সমিতির পদধারী নেতাদের ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে অব্যাহতি ঘোষণা করা হবে এবং রাত আটটার পর ছাত্র-জনতা ও সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচির ডাক দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর মাহমুদ বলেন, ‘চলমান সংকট নিরসনে প্রশাসন ও ঢাকার নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংকট নিরসন করে বাস চলাচল যেন স্বাভাবিক করা যায়।’