
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ। মাছ ভেজে পরিবেশনের জন্য দ্বীপে গড়ে উঠেছে ৫০টির বেশি রেস্তোরাঁ। তবে দ্বীপে এসব মাছের আর দেখা মিলছে না এখন। স্থানীয় জেলেরা টানাজাল ফেলে আহরণ করছেন ‘ফ্লাইংফিশ’, ‘টুইট্যা’ এসব মাছ। সেসব দিয়েই চাহিদা মেটাচ্ছেন পর্যটকেরা। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে গিয়ে এমন চিত্র চোখে পড়ে।
দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মৎস্য খনি হিসাবে পরিচিত সেন্ট মার্টিনে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বছর আগেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে শত মেট্রিক টন মাছ টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হতো। এখন সাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু জেলে দ্বীপের পূর্ব সৈকতে টানাজাল ফেলে ছোট আকৃতির ফ্লাইংফিশ, টুইট্যামাছ আহরণ করে ভ্রমণে আসা পর্যটকের চাহিদা পূরণ করছেন। কিছু রেস্তোরাঁ ও হোটেল মালিক টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ থেকে কোরাল, রুপচাঁদা, কালোচান্দা, লাক্ষা, মাইট্যা মাছ কিনে এনে সংকট দূর করছেন। সাগরে মধ্যে থেকেও দ্বীপের মানুষ সামুদ্রিক মাছের নাগাল পাচ্ছেন না। দ্বীপে মাছ ধরার ইঞ্জিন নৌকা আছে দুই শতাধিক। ৯০ শতাংশ নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে।
অচেনা মাছ, তবু খাচ্ছেন মানুষ
একটি রেস্তোরাঁয় বসে ভাতের সঙ্গে ফ্লাইংফিশ খাচ্ছিলেন ঢাকার মুগদাপাড়ার ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন। পাশে বসে তাঁর স্ত্রী খাচ্ছেন সুরমা মাছ। জীবনে প্রথম ফ্লাইংফিশ খাচ্ছেন জানিয়ে সোহরাব হোসেন (৩৭) বলেন, কমবেশি সবাই এই মাছ তেলে ভেজে খাচ্ছেন। তা দেখে তিনিও খাচ্ছেন। স্বাদও অনেক। অচেনা হলেও সামুদ্রিক মাছ খেতে সমস্যা হচ্ছে না।
বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ফ্লাইংফিশ ও টুইট্যা মাছের সঙ্গে সুরমা, কোরাল, লবস্টার, সামুদ্রিক কাঁকড়া সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ২৬০-৩৫০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি ভাজা ফ্লিইংফিশ ও টুইট্যা মাছ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। কাঁকড়া ১০০-১৫০ টাকা, লবস্টার ৩০০-৭০০ টাকা, সুরমা প্রতিটি ১২০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জেলে শ্রমিক সমিতির সভাপতি মো. আজিম (৪০) বলেন, কয়েক মাস আগেও দ্বীপের জেলেরা পশ্চিম-দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে জাল ফেলে ইলিশ, সুরমা, কোরাল, রূপচাঁদাসহ বিভিন্ন মাছ ধরে আনতেন। এখন মাছ গভীর সাগরে চলে গেছে। সেন্ট মার্টিনের নৌকাগুলো এত গভীরে গিয়ে জাল ফেলার সক্ষমতা রাখে না। অধিকাংশ নৌকা সন্ধ্যায় সাগরে নেমে রাতভর মাছ ধরে সকালে দ্বীপে ফিরে আসে। আর টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের ট্রলারগুলো গভীর সাগরে সাত-আট দিন অবস্থান করে মাছ আহরণ করে।
আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ হলে দ্বীপের মানুষের সংকট বাড়বে। এ কথা জানিয়ে মানবাধিকার কমিশন সেন্ট মার্টিন শাখার সহসভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, দ্বীপের ১১ হাজার বাসিন্দার ৯০ শতাংশের জীবিকা নির্বাহ হয় সামুদ্রিক মাছ আহরণের মাধ্যমে। গত ছয়–সাত মাস সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় ঘরে ঘরে অর্থসংকট চলছে। মাছ আহরণ ছাড়া লোকজনের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাও দ্বীপে নেই।
ভোর-সন্ধ্যায় মাছ আহরণ, বালুচরে বেচাবিক্রি
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে প্রবালসমৃদ্ধ পাথরের স্তূপ। সেখানে জাল ফেলা যায় না। তবে দ্বীপের উত্তর ও পূর্ব কোণে এক কিলোমিটার সৈকতে (জেটিঘাট এলাকা) পাথরখণ্ড নেই। সেখানে ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় টানাজালে মাছ ধরেন অর্ধশতাধিক জেলে।
দিনের বেলায় ফ্লাইংফিশ ও টুইট্যা মাছ ধরা পড়ে না। ভোর ও সন্ধ্যা বেলায় জোয়ারের পানিতে লাফ মারে; তাই মাছের নাম ফ্লাইংফিশ। আর টুইট্যা মাছ দল বেঁধে ঢেউয়ের তালে খেলতে খেলতে উপকূলের দিকে ছুটে আসে। তখন জালে আটকা পড়ে বলে জানান দ্বীপের জেলে সাইফুদ্দিন (৪৫)।
সম্প্রতি সকাল ছয়টায় সৈকতে নেমে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে চারটি নৌকায় টানাজাল ফেলে ছোট মাছ ধরছেন ৮০ জনের বেশি জেলে। সোয়া এক ঘণ্টার মাথায় জালে জ্যান্ত মাছের লাফালাফি দেখা যায়। তবে অধিকাংশই ফ্লাইংফিশ ও টুইট্যা মাছ। কয়েকটি লবস্টার, লাল কোরালও ধরা পড়ে জালে। বালুচরে সেই মাছ স্তূপ আকারে রেখে চলে বেচাবিক্রি।
দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ রহিমের মালিকানাধীন একটি নৌকার জালে ধরা পড়ে তিন মণ টুইট্যা ও ফ্লাইংফিশ। প্রতি কেজি মাছ বিক্রি হয় ৩০০ টাকা দরে। মোহাম্মদ রহিম (৬০) বলেন, বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের নাগাল পাচ্ছেন না দ্বীপের আড়াই হাজার জেলে। একসময় দ্বীপের মানুষ ফ্লাইংফিশ ও টুইট্যা মাছ খেতেন না। এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের ৩০০ টাকায় কিনে এই মাছ খাওয়ার সাধ্য নাই।
নৌকার মালিক ও দ্বীপের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা আলী আহমদ (৫৫) বলেন, তাঁর নৌকায় জেলে আছে ২০ জন। সকাল ও সন্ধ্যায় টানাজালে আহরিত মাছ বিক্রি করে ১০-২০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। জেলেদের দৈনিক মজুরি ৫০০-৭০০ টাকা। অধিকাংশ টাকা জেলে ও শ্রমিকদের বেতনের বিপরীতে খরচ হয়ে যায়।
সেন্ট মার্টিন দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান খান বলেন, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে গত ১ ডিসেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন দৈনিক দুই হাজার পর্যটক। দৈনিক তাঁদের চাহিদা পূরণে দরকার ২০-৩০ মণ সামুদ্রিক মাছ; কিন্তু সেন্ট মার্টিনের মাছে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকেরা টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ থেকে মাছ নিয়ে আসছেন।
স্থানীয়দের নাগালের বাইরে মাছ-মাংস
দ্বীপের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা নবী হোসেন (৫৫) বলেন, গত কোরবানির ঈদে গরুর মাংস খেয়েছিলাম। এরপর আর মাংসের নাগাল পাইনি। মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দ্বীপে ৭০ শতাংশ মানুষ কয়েক মাস ধরে মাছ খেতে পারছেন না। ৩১ জানুয়ারি পর পর্যটকের সমাগম বন্ধ হয়ে গেলে তখন কিছু মানুষের ভাগ্যে ফ্লাইংফিশ কিংবা টুইট্যা মাছ জুটতে পারে।
স্থানীয় একটি দোকানের মালিক রশিদ আহমদ বলেন, দ্বীপবাসীর খাবার জোগান দিতে হয় ৩৪ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ পৌরসভা থেকে। একাধিক ট্রলারে ভরে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল-তরকারিসহ নিত্যপণ্য দ্বীপে আনা হয় বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদী অতিক্রম করে। পণ্যবোঝাই ট্রলার নাফ নদী অতিক্রমের সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গুলি করার ঘটনাও ঘটে অহরহ। এ কারণে নৌ চলাচল বন্ধ হলে দ্বীপে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগর উত্তাল হলেও নৌ চলাচল বন্ধ থাকে। তখন নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে দ্বীপের বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮০ টাকা, আলু ৬০-৯০ টাকা, শিম ৭৫ টাকা, বেগুন ৯০ টাকা, মুলা ৪০-৫০ টাকা, গাজর ১২০ টাকা, সয়াবিন তেল ১৯৫ টাকা, চাল ৭৫-৯০ টাকা, চিনি ১৪০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা, ডিম ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের কেজি ৮৫০ থেকে ১ হাজার টাকা।