১৮৯০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাটের জমিদার লক্ষ্মী চরণ সাহা প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন। দুই গম্বুজবিশিষ্ট জমিদারবাড়িটির অনন্য স্থাপত্য এখনো মুগ্ধ করে সবাইকে। ১৯৩৪ সালে এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সংগীতের কিংবদন্তি এই সুরস্রষ্টা সত্য সাহা। এই বাড়িতেই হয়েছিল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘অশিক্ষিত’–এর শুটিং।
দুই গম্বুজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল জমিদারবাড়িটি দূর থেকেই আলাদা করে চোখে পড়ে। কারুকার্যখচিত দেয়াল, নকশা করা কার্নিশ আর কাঠের ছাদের স্থাপত্য আজও জানান দেয়, একসময় এই বাড়িতে ছিল আড়ম্বর, রুচি আর প্রাচুর্যের স্পষ্ট ছাপ। দোতলা কাচারিঘর, বিগ্রহ মন্দির, দুটি দালান আর শানবাঁধানো পুকুর মিলিয়ে জমিদারবাড়িটি ছিল এক পূর্ণাঙ্গ ‘জীবনকেন্দ্র’। কিন্তু ১৩৫ বছরের পুরোনো এই স্থাপনা আজ আর আগের মতো প্রাণবন্ত নয়। সময় এখানে থেমে থাকেনি; নীরবে, ধীরে ধীরে সে ভেঙে নিচ্ছে সবকিছু।
এটি দেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সত্য সাহার পৈতৃক বাড়ি। চট্টগ্রাম নগর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট গ্রামে এই জমিদারবাড়ির অবস্থান। ১৮৯০ সালে জমিদার লক্ষ্মী চরণ সাহা প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন। লক্ষ্মী চরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহার হাত ধরেই নন্দীরহাট গ্রামে জমিদারি প্রথার গোড়াপত্তন হয়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগপর্যন্ত এর দেখভাল করেন লক্ষ্মী চরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহা। পরে কিংবদন্তি সুরকার ও গীতিকার সত্য সাহার বাড়ি নামেই পরিচিতি পায় এই পুরোনো বাড়ি।
ব্রিটিশ আমলে নন্দীরহাট ছিল জমিদার ও মন্দিরসমৃদ্ধ এক ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। একাধিক রাজবাড়ি ও মন্দিরের কারণে এটি ‘মন্দিরের গ্রাম’ নামেও পরিচিতি পায়। সেই প্রেক্ষাপটে সত্য সাহার পৈতৃক জমিদারবাড়িটি ছিল বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। আজও দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থী ও ইতিহাসপ্রেমীরা এখানে আসেন, যদিও চোখে পড়ে এক করুণ বাস্তবতা।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল উঠানে চেয়ার পেতে বসে গল্পে মেতে উঠেছেন বাড়ির কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। আমাদের দেখেই হাসিমুখে স্বাগত জানালেন তাঁরা। কথায় কথায় খুলে যেতে থাকে জমিদারবাড়ির হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প। বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী রমা সাহার বয়স এখন ৮৪ বছর। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। স্মৃতিচারণা করে বলেন, একসময় এই বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বণ হতো। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীতে ভরে যেত উঠান। পাটি বিছিয়ে চলত খাওয়াদাওয়া। এখন সবই অতীত।
স্থাপত্যের দিক থেকেও বাড়িটি ব্যতিক্রমী। এর দুটি অংশ; সামনের দালানটি দোতলা, দালানের সঙ্গে যুক্ত বিশাল লোহার ফটক। ফটক পেরোলেই ডান পাশে কাচারি ঘর, যেখানে একসময় প্রজাদের খাজনা আদায় হতো। বাঁ পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি-কারুকার্যখচিত লোহার বেষ্টনীতে ঘেরা। সিঁড়িটি ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে আর ছাদের দুই পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দুটি বড় গম্বুজ।
স্থাপত্যের দিক থেকেও বাড়িটি ব্যতিক্রমী। এর দুটি অংশ; সামনের অংশটি নির্মাণ করেন জমিদার লক্ষ্মী চরণ সাহা আর পেছনের অংশটি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রসন্ন কুমার সাহা, যিনি সত্য সাহার পিতা। সামনের দালানটি দোতলা, দালানের সঙ্গে যুক্ত বিশাল লোহার ফটক। ফটক পেরোলেই ডান পাশে কাচারিঘর, যেখানে একসময় প্রজাদের খাজনা আদায় হতো। বাঁ পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি—কারুকার্যখচিত লোহার বেষ্টনীতে ঘেরা। সিঁড়িটি ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে, আর ছাদের দুই পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দুটি বড় গম্বুজ।
পেছনের দালানটিও দোতলা। ওপরতলায় রয়েছে থাকার ঘর, প্রতিটি ঘরের সঙ্গে প্রশস্ত বারান্দা। বাতাস চলাচলের জন্য বড় বড় জানালা, নিচতলাতেও একই রকম কক্ষ বিন্যাস। রয়েছে সুবিশাল একটি বারান্দা, যেখানে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন।
বাড়ির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, প্রতিটি দেয়াল যেন কথা বলে। কারুকার্যখচিত দেয়ালে হাত রাখলে ছুঁয়ে যায় শত বছরের ইতিহাস। কোথাও চুন খসে পড়েছে, কোথাও নকশা ঝাপসা—তবু সেই অলংকরণ এখনো গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। শানবাঁধানো পুকুরঘাটের পাশে পারিবারিক শ্মশান—জীবন আর মৃত্যুর সহাবস্থান যেন বাড়িটির ইতিহাসকে আরও গভীর করে তোলে। বোঝা যায়, এটি শুধু ইট-সুরকির স্থাপনা নয়; এটি সময়ের ভান্ডার, স্মৃতির এক নীরব সংগ্রহশালা।
এই বাড়ির প্রতিটি করিডর, প্রতিটি কক্ষ বহন করে সত্য সাহার শৈশবের স্মৃতি। এখানেই ১৯৩৪ সালে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সংগীতের কিংবদন্তি এই সুরস্রষ্টা। ষাটের দশকে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর সংগীতযাত্রা। ভারতের কিংবদন্তি সুরকার সলিল চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর সুরকে করে তোলে আরও গভীর ও সংবেদনশীল। লতা মঙ্গেশকরের মতো শিল্পীর সান্নিধ্য তাঁর সংগীতচিন্তায় যোগ করে আন্তর্জাতিক মাত্রা।
আবেগ আর মেলোডির নিপুণ কারিগর সত্য সাহা অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেলেও তাঁর জীবন ছিল সহজ ও সংযত। সংগীতের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বিনিময়’, ‘রাম রহিম জন’, ‘পুরস্কার’, ‘তোমার জন্য পাগল’—এর মতো জনপ্রিয় সিনেমা তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত।
পরিবারের সদস্যরা জানান, রাজ্জাক অভিনীত ‘অশিক্ষিত’ ছবির শুটিং হয়েছিল এই জমিদারবাড়িতে। ১৮ দিন ধরে শুটিং হয়। তখন সিনেমার আলো, ক্যামেরা আর শিল্পীদের আনাগোনায় বাড়িটি আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। আজ সেই স্মৃতিগুলো গল্প হয়েই রয়ে গেছে।
ব্যবসায়ী নীতিশ সাহা বলেন, সত্য সাহা ছিলেন তাঁর মামা। একসময় এই বাড়িতে ১৫টি পরিবার মিলেমিশে থাকত। দুর্গাপূজার দিনগুলোতে বাড়িটি হয়ে উঠত রঙিন ও মুখর। এখন মাত্র পাঁচটি পরিবার এখানে বসবাস করছে। তাই আগের সেই জৌলুশ আর নেই।
নন্দীরহাটের স্থানীয় বাসিন্দা অলক রঞ্জনের কথায়, সামান্য যত্ন আর পরিকল্পিত সংরক্ষণ পেলে এই জমিদারবাড়ি হতে পারত ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক জীবন্ত পাঠশালা। বাস্তবে তা না হয়ে অবহেলায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সত্য সাহার স্মৃতিবাহী এই ঐতিহাসিক স্থাপনা। এখন জরাজীর্ণ। আজও যেন অপেক্ষায়, কেউ এসে তার গল্পগুলো নতুন করে শুনবে, আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেবে।