রাজশাহী নগরের বাটার মোড়ের জিলাপি
রাজশাহী নগরের বাটার মোড়ের জিলাপি

রাজশাহীতে ইফতারের ঐতিহ্য শাহি ফিরনি আর বাটার মোড়ের জিলাপি

আধুনিক নানা ইফতারসামগ্রীর ভিড়ে রাজশাহীর ইফতারে এখনো জায়গা দখল করে আছে ঐতিহ্যবাহী শাহি ফিরনি। গণকপাড়া মোড়ের রহমানিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর এই ফিরনি ১৯৫০ সাল থেকে তৈরি করা হচ্ছে।

এ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অন্যসব ইফতারির মধ্যে ফিরনি ছোট ছোট মাটির পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতি পাত্রে ফিরনি আছে ১০০ গ্রামের মতো। বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। নগরের তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকার বাসিন্দা এন্তাজ আলী দুই পাত্র ফিরনি কিনলেন। তিনি বলেন, আরও অনেক ইফতার কেনা হয়েছে। কিন্তু ইফতারে ফিরনির একটা আলাদা মূল্য আছে তাঁর বয়সীদের কাছে। এখনকার অনেকেই হয়তো এই আইটেম কম পছন্দ করবে।

হোটেলের মালিক রিয়াজ আহাম্মেদ খান বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে তাদের এই খাবার হোটেলের শুরু। তখন থেকেই তাঁর দাদা আনিছুর রহমান খান অন্য খাবারের সঙ্গে এই হোটেলে শাহি ফিরনি বিক্রি শুরু করেন। দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা আবদুল বারি খান এ ব্যবসার হাল ধরেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি এখন এ ব্যবসায় আছেন। তিনি বললেন, এখন আর এটা ব্যবসা হিসেবে দেখা হয় না। বাপ-দাদার শুরু করা ফিরনি এখনো চালু রেখেছেন। কারণ, এটা তাঁদের কাছে এখন ঐতিহ্য। রাজশাহীর বাইরে তাঁদের হোটেলের পরিচিতি শুরু হয়েছিল এই ফিরনি দিয়ে। শুরুতে এক বাটি ফিরনি চার আনায় বিক্রি হতো, এখন তা ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এবার রমজানের প্রথম দিনে ৪০০ বাটি ফিরনি করা হয়েছিল, সব বিক্রি হয়ে গেছে। এটি আরও বাড়বে। গত বছর দৈনিক এক হাজার বাটি পর্যন্ত ফিরনি বিক্রি করেছেন তাঁরা।

ইফতারে রাজশাহীর রহমানিয়া হোটেলের ফিরনি কিনতে ভিড় করেন অনেকে। নগরের গণকপাড়া মোড়ে

শাহি ফিরনি বানানোর বিষয়ে রিয়াজ আহাম্মেদ খান বলেন, এটা ইফতারে সবচেয়ে সুস্বাধু খাবার। গরুর খাঁটি দুধ এর প্রধান উপাদান। এর সঙ্গে চালের গুঁড়া, চিনি ও কিছু ফল থাকে।

এদিকে নগরের বাটার মোড়ে একটি দোকানে মচমচে জিলাপি বিক্রি করা হয়। এ দোকানের কোনো নাম, সাইনবোর্ড নেই। ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ নামেই টিকে আছে। এটিও রহমানিয়ার মতোই পুরোনো দোকান। জিলাপি কিনতে এই মোড়ে বিকেল থেকেই ভিড় জমতে থাকে। সন্ধ্যার আগে এখানে লাইন ধরে জিলাপি কেনেন ক্রেতারা। সারা বছরই এই মোড়ে জিলাপি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি জিলাপি বিক্রি হয় ২২০ টাকায়।

১৯৫০ সালের দিকে বাটার মোড়ে জিলাপি বানিয়ে বিক্রি শুরু হয়। ইফতারে অনেক রোজাদারের পছন্দের তালিকায় থাকে এই পদ

সোমবার বিকেলে এখান থেকে আধা কেজি জিলাপি কিনলেন নগরের গোরহাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, এখানকার জিলাপি স্বাদে একটু ভিন্ন। রমজান এলে মাসে অন্তত ১০-১২ দিন তিনি এখান থেকে জিলাপি কেনেন।

এই দোকানের মালিক ও কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫০ সালের দিকে এখানে জিলাপি বানানো শুরু হয়। এ ব্যবসা শুরু করেন সোয়েব উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। সে সময় তাঁর একমাত্র কারিগর ছিলেন জামিলী সাহা। ১৯৭২ সাল থেকে জামিলী সাহার ছেলে কালীপদ সাহা বাবার সঙ্গে জিলাপির কারিগর হয়ে উঠতে শুরু করেন। এরপর ১৯৮০ সালে জামিলী সাহা মারা গেলে কালীপদ সাহা প্রধান কারিগর হয়ে ওঠেন। তিনি মারা যান ২০১৭ সালে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর শিষ্য মো. সাফাত জিলাপি বানাচ্ছেন।

এক বাটি শাহি ফিরনি শুরুতে চার আনায় বিক্রি হতো, এখন তা ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে

সোয়েব উদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর চার ছেলে জিলাপির দোকানটি পরিচালনা করছেন। তাদের একজন মো. হাসিম উদ্দীন বলেন, ‘এত বছর ধরে এটি আস্থার সঙ্গে টিকে আছে, তার অন্যতম কারণ সততা। একেবারে ভালো মানের উপকরণ দিয়ে জিলাপি বানানো হয় এখানে। এ কারণে সারা বছরই বিক্রি হয়। রমজানে বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।’

এই দোকানের কারিগর মো. সাফাত ৪২ বছর ধরে জিলাপি তৈরি করছেন। তিনি জিলাপি ভাজতে ভাজতে বলছিলেন, ‘উস্তাদ কালীবাবুর কাছ থেকে জিলাপি বানানো শিখেছি। উপকরণগুলোর পরিমাণ, চিনির পরিমাণ, ভাজার পরিমাণ ঠিকঠাক রাখতে হয়। তাহলে জিলাপির একটি আলাদা রং আসে, আর মচমচে ও টসটসে হয়।’