অদম্য মেধাবী-২০২৫—৯

সাফল্যের পরও ফিকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন

দুঃসহ বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে সাফল্যের দেখা পেয়েছে একদল শিক্ষার্থী। ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন আঁকড়ে এগিয়ে চলেছে তারা।

প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা। তবে সবার জীবনের ছবিতে কেবল অভাব আর সংগ্রাম। কারও মা সেলাই মেশিনে বসে রাত জাগেন, কারও বাবা খেতে কাজ করে দিন পার করেন। ঘরে নেই নিশ্চিন্ত আহার, নেই পড়াশোনার সচ্ছল পরিবেশ। তবু থেমে থাকেনি স্বপ্ন দেখা। জীবনের দুঃসহ বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে তারা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।

শেরপুরের কামরুন নাহার, ফরিদপুরের অর্পা সাহা, যশোরের মেহজাবিন কিবরিয়া ও সিরাজগঞ্জের আশিক ইকবালেরা কেউ শিক্ষক হতে চায়, কেউ চিকিৎসক। এখন তাদের পথচলার সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—অভাবের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া যাবে তো?

আধা পেট খেয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন

বাবা নেই। মা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। সেই ঘরে বড় হচ্ছে এক মেয়ে, যার চোখে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু রাতে প্রায়ই ঘুমাতে যায় আধা পেটে। সুযোগ হয়নি টিউশনি পড়ারও। এমন বাস্তবতার মধ্যেও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে কামরুন নাহার।

শেরপুরের শ্রীবরদীর খামারিয়াপাড়া গ্রামের মেয়ে কামরুন। উপজেলার মাথুরানাথ বিনোদিনী পাইলট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিল সে। ভালো ফল করলেও মেধাবী এই ছাত্রী এখন কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনা খরচ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, কামরুন নাহার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্ট্রোকে মারা যান চা-দোকানি বাবা সোহেল মিয়া। এরপর মা কনিকা খাতুন ও ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের সংসার। কোনো উপায় না দেখে দরজির কাজ শেখেন কনিকা খাতুন। গ্রামের নারীদের কাপড় তৈরি করে কোনোভাবে সংসার চালান তিনি। কামরুন নাহারও পাশে থেকেছে—কখনো মাকে সেলাইয়ে সাহায্য করেছে, কখনো ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে।

আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক ও বন্ধুরা পাশে না থাকলে অনেক আগেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত বলে জানায় কামরুন নাহার। কনিকা খাতুন বলেন, ‘এখন কলেজে ভর্তির খরচ কীভাবে জোগাড় করব, বুঝতে পারছি না।’

কামরুনের বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, অভাব-অনটনে কলেজে ভর্তি নিয়েই কামরুন নাহারের পরিবার এখন শঙ্কায় আছে।

কষ্ট কখনো কষ্ট মনে হয়নি অর্পার

‘গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতাম। আবার ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো। বাড়ি থেকে হেঁটেই দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হতো। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনার বাইরে মা–বাবার কাছে টাকা চাইতাম‌ না। শীতের ভোরে আর বর্ষাকালে ক্লাসে যাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠত। অবশ্য এ কষ্ট আমার কাছে কখনো কষ্ট মনে হয়নি। লক্ষ্য ছিল একটাই—আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, মা–বাবার দুর্দশা ঘোচাতে হবে।’

কথাগুলো বলছিল ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা বিদ্বান কুমার সাহা ও মৃদুলা রানী সাহা দম্পতির মেয়ে অর্পা সাহা। চলতি বছর সে শিবরামপুর রাম গোপাল দীনবন্ধু একাডেমি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ–৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে। এমন সাফল্যের জন্য মা-বাবার পাশাপাশি স্কুল ও প্রাইভেট শিক্ষকদের ভূমিকার কথা বলে অর্পা। তার স্বপ্ন একজন শিক্ষক হওয়ার।

মৃদুলা সাহা জানান, পারিবারিক আয়ের উৎস ছোট একটি মুদিদোকান। কীভাবে সামনের দিনগুলো চলবে, পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে আসবে, সে কথা ভেবে ভেবে কাটে দিন–রাত।

অর্পার স্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম মিঞা জানান, অর্পার পরিবারটি দরিদ্র। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি একটু সাহায্য–সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেয়, তা ওর স্বপ্নপূরণে ভূমিকা রাখবে।

অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই এগোচ্ছে মেহজাবিন

অনেক বছর ধরে বাবার স্নেহ–ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত মেহজাবিন কিবরিয়া কনি। বাবা মাদকাসক্ত হওয়ায় সংসার ছেড়ে মা রেক্সোনা বেগম তাকে নিয়ে চলে আসেন যশোর শহরে। বাজারের ব্যাগ সেলাই করে কোনোমতে সংসার চালান তিনি। সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই এ বছর মেহজাবিন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে।

মেহজাবিনের বাবার বাড়ি নড়াইলে। সংসারে অভাব–অনটন, তার ওপর স্বামীর খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে মেয়েকে নিয়ে যশোর সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুরে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন রেক্সোনা বেগম। মেহজাবিন সেখানেই ভর্তি হয় প্রগতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বিনা টাকায় পড়িয়েছেন তাকে। তিনি বলেন, ‘মেহজাবিন খুব মেধাবী। কষ্টের মধ্যেও সে মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে। বৃত্তি পেলে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’

মা রেক্সোনা বেগম বলেন, ‘মেহজাবিনের লেখাপড়ার খরচ চালানো নিয়ে চিন্তায় আছি।’

প্রাইভেটের টাকা দিতে পারত না আশিক

এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের আশিক ইকবাল ও তার পরিবার। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে তার।

আশিক ইকবাল উপজেলার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের দৈবকগাতী গ্রামের ক্ষুদ্র বর্গাচাষি আমির হোসেন ও গৃহিণী আসমা বেগমের বড় ছেলে। সে উপজেলা সদরের ধানঘরা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল।

আমির হোসেন বলেন, ‘সামান্য বর্গা চাষের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। তাই ছেলের কলেজে পড়ালেখার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

আশিক ইকবাল বলে, এসএসসির ধারাবাহিকতায় এইচএসসি পর্যায়ে ভালো ফল করতে চায় সে। মা–বাবার সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য আশিক সবার দোয়া কামনা করে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর, প্রতিনিধি, নালিতাবাড়ী, শেরপুর ও রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ এবং যশোর অফিস]